Home শিশুতোষ গল্প কোকিল আর এক কাক (শিশুতোষ গল্প-৮)

কোকিল আর এক কাক (শিশুতোষ গল্প-৮)

by Admin

কোকিল আর এক কাক

মোঃ নোমান সরকার

খুব বিরক্ত হয়ে ঘাড় বাকিয়ে ছোট কোকিলটা বড় গাছের নিচে নাপিতের লাগানো নতুন দোকানটা দেখল । সকাল থেকে বসে আছে সে গাছের ডালে ! খাবার খুঁজতে বের হয়নি । সকালে এক নাপিত ঠুক ঠুক করে গাছের গোরায় পেরেক মেরে যখন বড় একটা আয়না ঝুলালো , তা দেখে খুব মন খারাপ হল তার ।

মানুষদের অত্যাচারে প্রতিদিন পাখিরা এই গ্রাম ছাড়ছে । গ্রাম থেকে প্রতিদিনই গাছ আর পাখি দুইটি অদৃশ্য হচ্ছে । কেউ না কেউ গাছ কাটছে । আর সেই সব গাছের পাখিরা শোকে শোকে গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে ।

পাশের গাছটা গত সপ্তাহে কাটা হয়েছে। কবে কখন এই গাছ কেটে ফেলে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল এই গাছের পাখিরা! সেই থেকে এক এক করে এই গাছের পাখিরাও চলে গেছে। শুধু ছোট কোকিল যায়নি । বয়সে সে অনেক ছোট ,অনেক বেশি উড়তে হলে কষ্ট হবে। তাই তার মা বলে গেছে , ‘’তুমি তো ছোট ,তাই নতুন বাসা খুঁজে বের করার মতন কষ্ট করার তোমার প্রয়োজন নেই। আবার , বয়স এতটাও কম না যে ,আমার সাহায্য তোমার দরকার হবে। তাই তুমি এখানেই থাকো। খুব বেশি একটা দূরে যেও না। কাছাকাছি এলাকা থেকে খাবার সংগ্রহ করে নিও, কেমন। ভাল আর সুবিধা মতন বাসা পেলে তোমাকে দুই একদিন পর নিয়ে যাব। ‘’

সেই থেকে কোকিলটা একা থাকছে এই গাছে । সকাল থেকে সে দেখতে লাগল নাপিতের দোকান সাজানো। লোকজনের আনাগোনা। মন তার খুব খারাপ হয়েছে ! তবে গাছ কেটে ফেলার চেয়ে এটা ভাল। এসব ভেবে ভেবে আর এসব শব্দ করে করে নিজেকে এটা সেটা বলে শুনিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই সকাল পেরিয়ে দুপুর হল । লোকজন একেবারেই কমে গেল। কোকিলটা এক সময় দেখল আসে পাসে নাপিত ছাড়া আর কেউ নেই। এর একটু পরে নাপিতও দোকানের পাসে ঘুমিয়ে গেল। অনেক ভেবে কোকিলটা নীচে নেমে এল , নাপিতের দোকানে। দোকানের কাছে আসতেই কোকিলের চোখ পরল আয়নায়। নিজেকে আয়নায় দেখে ঘাবড়ে গেল ! ভাবল অন্য কোন কোকিল ! আরে এই কোকিলটা , এখানে কখন এল! তারপর একটু পরেই বুঝল , এটা সে নিজেই ! কোকিলটা আরেক বার ঘুমন্ত নাপিতকে দেখল। তারপর চারপাস দেখে আয়নার কাছাকাছি উড়ে এসে বসলো। তারপর নিজেকে দেখল । দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ! আমি এত সুন্দর ! আরে কি আশ্চর্য ব্যাপার , আমি এতই সুন্দর !

সেই দিন থেকে ছোট কোকিল রোজ কয়েকবার উড়ে যায় আয়নার কাছ দিয়ে । আর চারপাসে কেউ না থাকলে উড়ে এসে বসে । নিজেকে দেখে । গর্বিত চাহনিতে নিজেকে দেখতেই থাকে । যেন নেশা কাটেনা এমনি ভাবে ।

এভাবেই চলল বেশ কয়েকদিন । একদিন কোকিল নীচের এক ডালে বসে আছে । তখন একটা কাক এসে গাছের ডালে বসল । কাককে দেখতেই কোকিল কিছুটা রেগে বলে উঠল ,’একটু দূরে গিয়ে বস , কি বিচ্ছিরি দেখতে ‘!

এ কথায় কাকের মন খারাপ হল । তবে বেশি একটা না । কারন এমন কথা সে আগেও অনেক বার শুনেছে । তার জন্য এটা নতুন কিছু না । কাকটা বিরক্ত হয়ে বলল , ‘ তা ভাই ,তুমি নিজেকে নিশ্চয় অনেক সুন্দর ভাবছ ‘?

কোকিল বিস্ময়ের সাথে বলে উঠল , ‘ তুমি কি আমাকে বলছ ! আমাকে ? আমাকে বলছ কি ‘?

কাক এদিক সেদিক তাকিয়ে কোকিলের দিকে তাকাল এবার । তারপর চাবিয়ে চাবিয়ে , ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলল,‘এখানে সম্ভবত আর কেউ তো নেই ‘!

কোকিলের ভীষণ মন খারাপ হল । মন খারাপ গলায় বলল, ‘ব্যাঙ্গ ছলে বললে বলে মনে হল ‘!

কাক এবার শান্ত গলায় বলল,‘তোমার কি মনে হয় , আমি মিথ্যে কিছু কি বলেছি ‘।

কোকিল উত্তেজিত গলায় বলল,‘তোমার চোখে কোন অসুখ নেই তো ‘।

কাক নিরশ গলায় বলল,‘নাতো ‘! কোকিল অবাক আর নীচু গলায় বলল,‘তবে তো তুমি আমাকে ভাল করে দেখনি ‘!

‘ হতে পারে আমি তোমাকে ভাল করে দেখিনি । ঠিক আছে ,আমি তোমাকে দেখে নেই তবে ‘।

কোকিল বলল , ‘আমাদের এই এলাকায় যত পাখী ছিল ,আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ! যদিও ইদানিং আমি আমার মা কে ছাড়া আর চড়ুইদের ছাড়া কাউকে দেখিনি । তারপরও আমি নিশ্চিত , আমি দেখতে কল্পনাতীত সুন্দর ‘ !

কাক কোকিলের কথায় অনেক বিরক্ত হল । তারপরও অনেকখন কাক কোকিলকে দেখতে লাগল ।

কাকের কথায় কোকিলের মন অনেক খারাপ হয়ে গিয়ে ছিল । অসুন্দর কাক কি অদ্ভুত কথা বলে ! সে নাকি সুন্দর না ! এবার নিশ্চয় ভাল করে দেখে , ঠিক করে বলবে ! কি অদ্ভুত সুন্দর আমি ! কি অপূর্ব সুন্দর চোখ ! কি অপূর্ব সুন্দর ঠোট ! কি অদ্ভুত সুন্দর তার ডানা ,আর ডানা মেলে ধরা ! নিজেকে সে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছে অজস্রবার ।

কাক কয়েক পা কোকিলের সামনে এগিয়ে এল । কাক আনন্দহীন গলায় বলল , আমি তো বলিনি , তুমি অসুন্দর । কিন্তু তুমি ততো সুন্দর নও । তোমার চেয়ে ঢের সুন্দর পাখিদের আমি দেখি প্রতিদিন । তাদের কাছে তুমি জৌলুসহীন ! সে কথা যাক ,তুমি ছোট একটা পাখী , সুন্দর নিয়ে তুমি এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন ! এতো একটা ফালতু বিষয়‘!

কাক অস্থির গলায় বলল,‘ কাক তুমি আমাকে খেপাচ্ছ ‘?

কাক অবাক হয়ে বলল,‘কেন কেন, তোমাকে খেপাতে যাব কেন ‘?

কোকিল রাগ আর অভিমান মিশানো স্বরে বলল ,‘বাহ রে ,তুমি যে ভুল বকে যাচ্ছ ‘! ‘আমি ! আমি তো আর সরাসরি তোমার মতন অসুন্দর বলে গাল দেইনি । আর ভুল বা কি বললাম‘!

কোকিল ভারী গলায় বলল,‘আমি আবার কখন অসুন্দর বললাম ‘ !

কাক গম্ভীর গলায় বলল ,‘ বিচ্ছিরি চেয়ে অসুন্দর শব্দটা অনেক শুনতে ভাল ‘।

‘কাকের কথায় কোকিল লজ্জা পেল । সে অনুতপ্ত গলায় বলল, তোমাকে আঘাত দেবার জন্য আমি দুঃখিত ‘!

কাকটা এবার হেসে ফেলে বলল , ‘ আচ্ছা এবার বল ,তুমি উড়তে পার কেমন ‘?

এই দুইদিনে দেখলাম ভাল উড়তে পারছি ‘।

কাক বলল, ‘ছোটদের বেশি দূরে যেতে নাই । তবুও তুমি আমার সাথে যেতে পার । যেখানে গেলে তোমার সুন্দর আর অসুন্দর নিয়ে ভুল টা ভাঙ্গবে ‘।

কোকিল বিস্ময়ের সাথে বলল , ‘সত্যি কি তুমি বলতে চাচ্ছ ,আমি তেমন সুন্দর নই ‘। কাক হেসে বলল ,আমি উড়ে যাচ্ছিলাম । তোমার অসম্ভব সুন্দর গলার স্বর শুনে এই ডালে বসেছিলাম । একটু থামল কাক । যেন কিসব ভাবছে । তারপর তেমনি হেসে বলল, চল , এই দুই গ্রাম পরে একটা জঙ্গল আছে । সেখানে তোমার উত্তর আছে । যদি সাহস কর ,তবে আমার পিছু নিতে পার‘। এই বলে কাক উড়ে গেল । কোকিল এক মুহূর্ত কিসব ভাবল । তারপর উড়ে গেল কাকের পিছু পিছু ।

তখন বিকাল । যখন ওরা জঙ্গলে পৌছাল । কোকিল বিস্ময়ে আর মুগ্ধতার সাথে দেখল , কত বিচিত্র সব ছোট বড় পাখী ! কি অবিশ্বাস্য সুন্দর সুন্দর রং তাদের ! কি অপূর্ব সুন্দর সুন্দর সেই সব পাখী ! আর নানান ধরনের ছোট বড় অসংখ্য গাছ । হতভাগা দুষ্ট মানুষ কি জানে এই গাছের কথা ! জানলে তো সর্বনাশ ! এই ভাবনাটা ভাবল বটে তবে জঙ্গলের সৌন্দর্য ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত পরেই ।

সন্ধ্যা নেমে এল । জঙ্গলের একটা গাছে কোকিল আর কাক আশ্রয় নিয়েছে । অচেনা জায়গার অন্ধকার কোকিলকে ভীত করতে পারেনি । তার মাথায় অনেক প্রশ্ন আর বিস্ময় নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল !

কোকিল চিন্তার জগতে ডুবে গেল । ভাবতে ভাবতে সে যেন হঠাৎ করে আবিস্কার করল । আমি সুন্দর , কি কম সুন্দর , এসব ভাবনায় কি আসে যায় ! আমি তো আমাকে বানাইনি ! যা কিছু আমার বলে এতদিন ভেবেছি তাতো আসলে আমার নয় । কেবল আমার কথা , কাজ আর আচরণ ছাড়া ! কাক দেখতে কতইনা অসুন্দর । অথচ সুন্দর করে কথা বলে । তবে তো সে ভাল । সে ভাল আমার চেয়ে । কারন আমি অসুন্দর করে ভাবি । বাজে বাজে শব্দে কথা বলি বা রেগে কথা বলি !

অন্ধকারে কাক প্রশ্ন করল , ‘ তুমি কি ভয় পাচ্ছ ‘?

কোকিল অন্ধকারে কাক কে দেখতে পেল না । সে মৃদু হেসে বলল , ‘ না । ভয় কিসের ! আমি ভাবছি ,আমি কি বোকা ছিলাম যে নিজেকে নিয়েই ভাবতে শিখেছিলাম । আমি আজ জেনেছি , নিজের দেখার মধ্যে কোন আনন্দ নেই ‘ ।

কাক হেসে বলল , বাহ্যিক সৌন্দর্য হচ্ছে সৃষ্টকর্তার দান । আর অন্তরের সৌন্দর্য নিজের ! বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে বড়াই করার কিছু নেই । একটু থমে কাক বলল , ‘এই যে বিশাল পৃথিবী তা আমাকে সব সময় জানায় , এস , দেখ ! উপভোগ কর এই পৃথিবীর যত দুঃখ আর আনন্দগুলো ‘ !


You may also like

Leave a Comment