মোঃ নোমান সরকার
এক দেশে দুই জন যমজ যুবক ছিল । তার নাম ছিল জাহিন আর মাহিন। একদিন তার দেশে অনেক দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। তারা দুই ভাই একই জায়গায় চাকরি করত। আর একই সাথে তাদের চাকরি হারালো। একদিন দুইদিন করে অনেক দিন কেটে গেল কিন্তু কোন কাজ খুজে পেল না। অবশেষে তারা ঠিক করল , চুরি করবে।
এদিকে যায় , সেদিকে যায় । বুঝে উঠে পারল না কোথায় চুরি করবে! একদিন তারা ঠিক করল চুরি যদি করতেই হয় তবে রাজার বাড়িতে চুরি করবে। যেই বুঝা সেই কাজ ! তারা দুই জন মিলে বুদ্ধি বের করল আর রাজপ্রাসাদে চুরি করতে গিয়ে রাজার প্রিয় গলার মালা নিয়ে আসলো।
পরের দিন রাজ্যময় সবাই জানল, রাজার প্রিয় গলার মালা চুরি যাবার কথা। কিন্তু অবাক কান্ড কিছু দিন পরে আবার রাজা নিজে তার বিছানায় গলার মালাটা পরে থাকতে দেখল! এ যে অবিশ্বাস্য! যে চুরি করেছে সে তা ফিরিয়ে দিয়েছে! এদিকে রাজা হুলংকার দিয়ে সবাইকে বললেন ,’’এত এত সৈন্য আর প্রহরীর মধ্য থেকে কিভাবে ঘটনাটা ঘটল!’’
তদন্ত পর তদন্ত হতে লাগল। কিন্তু তদন্তের ফলাফল শূন্য! রাজা ক্ষেপে গিয়ে বললেন ,’’এটা যে করেছে সে বা তারা তো রাজাকেও মেরে ফেলতে পারত ।‘’ রাজা সেদিনই আদেশ দিলেন নতুন রাজপ্রসাদ বানানোর জন্য। আরও নতুন নতুন কৌশল নিলেন এই ভয়ংকর চোর ধরার জন্য।
নতুন রাজপ্রাসাদ বানানো হল। রাজপ্রাসাদের চারদিকে বিশাল পুকুর খনন করা হল । বিশাল চওড়া করে বিত্ত আকারে সেই বিশাল পুকুরে অসংখ্য কুমির ছেড়ে দেওয়া হল। মাত্র কয়েকজন প্রহরী থাকে নতুন এই রাজপ্রাসাদে।
এরমধ্যে একটা খবর ছড়িয়ে গেল রাজা নাকি একটা হীরার টুকরো রেখেছেন নতুন রাজ প্রসাদের কোথাও । সে কথা জাহিন আর মাহিন শুনল। আরও শুনল বিশাল পুকুর আর কুমিরের কথা। তারা ভাবতে বসল কিভাবে আবার সবাই কে বোকা বানিয়ে হীরাটা চুরি করা যায়। যেই বুঝা সেই কাজ। সন্ধ্যার পর পর জাহিন হাজির হল রাজপ্রসাদে।
কিছুখন পরেই সে দেখতে পেল প্রাসাদের উচু জায়গা থেকে রাজাকে। রাজা পায়ে হেঁটে প্রাসাদের এক কোনায় একটি আলাদা বিশাল ঘর আছে। রাজা সেই ঘরে ঢুকলেন। এভাবে জাহিন পরপর দুই দিন সন্ধ্যার পরে এসে দেখল রাজা সেই বিশেষ কোনার ঘরটায় ঢুকেন । আর সেই ঘর থেকে বের হন অনেক রাতে ! জাহিনের সন্দেহ হল ,এটা কি সেই জায়গা যেখানে হীরাটা রাজা লুকিয়ে রেখেছেন ! হতে পারে , খুব হতে পারে !
দ্বিতীয় দিনের রাতে সে দেখল রাজা ঢুকল কিন্তু দরজাটা একটু ফাঁকা ! সে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল ! তারপর নেমে এলো প্রাসাদের ছাদ থেকে। তারপর ঢুকে গেল ঘরের ভিতর। ঘর তো নয় এ এক ভিন্ন ধরনের তিন তলা প্রাসাদ। এখানে আছে শুধু বই আর বই । এ যেন এক বই এর নগরী ! ছোট বড় আলমারিতে কেবলই বই । জাহিন তখনই শুনতে পাচ্ছে রাজার গলা। রাজার গলা সে অনেকবারই সে শুনেছে । প্রজাদের মধ্য অনেক বার গিয়েছেন রাজা। রাজার গলা শুনে জাহিন সব ভুলে এগিয়ে গেল নীচের দিকে । আরও স্পষ্ট ভাবে শুনল ,রাজা জোরে জোরে বলে যাচ্ছে , ‘’ অ ,আ ,ই ,ঈ ,ও ! অ,আ,ই,ঈ ,ও ! অ,আ,ই,ঈ,ও !’’
রাজা পড়ছেন ! জাহিন যতটা সম্ভব সাবধানে কাছে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখলেন ,রাজার পাশে একজন বৃদ্ধ লোক বসে আছেন। তিনি রাজা কে পড়াচ্ছেন। আর রাজার হাতে বই। তিনি পড়ে চলেছেন! দুই জনই খুব মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন বই এর দিকে !
জাহিন পড়াশুনা করেনি। কিন্তু মক্তব আর টোল দেখেছে । কিন্তু রাজা কি ছোট বাবু যে রাজা এসব পড়বে! তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। জাহিন একটা আলমারির পিছনে লুকিয়ে আছে অনেক খন ধরে। সে দেখল রাজার চলে যাওয়া। আর দেখল বৃদ্ধ শিক্ষককে নীচে চলে যেতে। বৃদ্ধ শিক্ষক যেতেই সে বেড়িয়ে এলো। তারপর একটা করে বই এর পাতা উল্টাতে লাগল। নিশ্চয় এই ঘরের কোন এক বইতে বা আলমারির কোথাও লুকান থাকতে পারে হীরাটা।
বেশ অনেক খন পেরিয়ে গেল হীরা পাওয়া গেল না। জাহিন বুঝল এই ঘরে হীরা নেই । এখান থেকে বেড়িয়ে মূল প্রাসাদে ঠুকবে বলে ঠিক করল। ঠিক তখনই বৃদ্ধ মানুষটির হেঁটে আসার শব্দ পেল । জাহিন দূর থেকে দেখল বৃদ্ধের হাতে একটা বই। বৃদ্ধ উঠে এলো। জাহিন লুকাল একটা আলমারির পিছনটায় । বৃদ্ধ বসল কাছের একটা টেবিলে , বই খুলে পড়তে লাগল। জাহিন বুঝল ,চট করে এখান থেকে বের হওয়া যাবে না। সে অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পরল।
কে যেন ঘুম ভাঙ্গল তখন জাহিন দেখল তার হাত পা বাধা ! লাফিয়ে উঠতেই পরে গেল। দেখল বৃদ্ধকে আর পাশে দাঁড়িতে মিটি মিটি হাসছে রাজা । ভয়ে আবার লাফ দিতে গেল। রাজা সব শুনল। দুর্ভিক্ষের কারনে মানুষ চুরি ,ডাকাতি করছে জেনে মন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়ে সে এলাকায় নতুন কাজ যেন তৈরি হয় ,তার ব্যবস্থা করল।
এবার বিচারের জন্য রাজ দরবারে হাজির করা হল জাহিন কে। কি করে এই রাজ প্রসাদে ঢুকতে পারল তার ব্যাখ্যা দিল সে। শুনে রাজা সহ সবাই অবাক।
জাহিন বলল , রাজ প্রসাদের উপরে এখন ঝুলে আছে একটা দড়ি। সেই দড়ির শুরুটা বহু দূরে। দড়ির শুরু লাগান আছে একটা বিশাল বট গাছে ।
মন্ত্রী বলল ‘’রাজা মশাই ও এগুলো কি বলছে ,কিছুই বুঝতে পারছি না।‘’
জাহিন আবার শুরু করল ,আমরা দুই ভাই একটা ঘুড়ির দোকানে চাকরী করতাম। একটা লম্বা মানুষ যতটা বড় আমাদের ঘুড়ি গুলো ততো বড় বড়। আমরা দুই ভায়ের কাজ ছিল ক্রেতাদের ঘুড়ি উড়িয়ে দেখানো। বড় গাছের সাথে বেঁধে ওগুলি নিয়ন্ত্রন করতাম। আমার আরেক ভাই মাহিন গাছে দাঁড়িয়ে দড়ির গোড়ার ধরে হাত আর পা দিয়ে উড়তে থাকা ঘুরি নিয়ন্ত্রন করত। আর আমি ঘুড়ির সাথে উড়ে চলতাম। দড়ির দুই হাত নীচে নীচে একটা করে গিট দেওয়া থাকত । তা দিয়ে আমি নীচে উপরে আসতে পারি। একদিন তার দেশে অনেক দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। আর আমরা চাকরী হারালাম। চাকরী হারিয়ে যখন ঠিক করলাম রাজার বাড়িতে চুরি করব। তখন এই পদ্ধতি কাজে লাগালাম। তবে রাজার গলার মালা চুরি করে আবার তা ফিরিয়ে দিলাম। আসলে আমরা চোর না। আমরা চুরি করেছি আমাদের গ্রাম গুলি খুব বড় ধরনের বিপদে আছে তা রাজা কে জানাতে। রাজার মনযোগ কাড়তে! সব শুনে রাজ সভার সবাই যেন ভড়কেই গেল। এত বুদ্ধি মানুষের হয়!
সবাই রাজার কাছে মিনতি করল চোর কে ক্ষমা করার। রাজা সব ভেবে রাজা জাহিনকে আর মাহিনকে ক্ষমা করে ঠিকই কিন্তু তিন মাস একটা বাড়িতে বন্দী করে রেখে তাদের পড়ালেখার সুযোগ করে দিলেন।
রাজা তাদের জ্ঞান বুদ্ধি সাহস নিয়ে ভাবতেই আবাক হলো। অবাক হলো তাদের চুরির কৌশল নিয়ে। আর ঠিক করল, তাদের রাজকর্মচারী হিসাবে নিয়োগ দিতে। রাজা মন্ত্রীদের সাথে এ নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন। আলোচনা করলেন বৃদ্ধ শিক্ষকের সাথেও।
পরের দিন রাজা এলো জাহিন আর মাহিনকে দেখতে। রাজা বলল , আমাকে দেখেছ পড়তে । জাহিন আর মাহিন বলল ‘হ্যা ।‘
রাজা এক গাল হেসে বলল , আমি রাজা! পড়াশুনা করি প্রজাদের সুখের জন্য।তাই আমি শুরু করেছি ,তোমরাও করো। এসো আমরা পড়াশুনা করি। আর সুখে থাকি ,এই সুখের রাজ্যে !
বেশ কয়েক দিন পরে জাহিন আর মাহিন প্রায় মুখস্ত করে ফেলেছে অ আ । জাহিন মাহিন কে বলল , দেখ ঠিক হয়েছে কিনা । অ আ ই ঈ উ ঊ !
মহিন আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠল ।।