মোঃ নোমান সরকার
সন্ধ্যা ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই। চাঁদ উঠেনি এখনো। রাজা ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার আগে কোলে রাখা হরিণটা শাবক সামলে নিলো। তারপর ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আকাশটা দেখে নিলো। হরিণটা কোল থেকে নামিয়ে নেওয়ার আগে একজন সৈনিক দৌড়ে ছুটে এসে হরিণটাকে কোলে তুলে নিয়ে রাজপ্রাসাদ থেকে দূরে একটা প্রাসাদের দিকে ছুটে গেল। এটি রাজকুমারীর খেলাঘর।
রাজা আজ ভোরে শিকারে গিয়েছিল। এবার তিনি একাই গিয়েছিলেন। এমনটি আগে কখনো হয়নি। যাবার আগে রাজকুমারীর কাছে জানতে চেয়েছিল, তার জন্য কি আনবে। রাজকুমারী বলেছিল একটা হরিণের কথা। শিকারে গিয়ে রাজকুমারী জন্য একটা হরিণ ধরতে না পারলেও একটা হরিণ শাবক ধরতে পেরেছিল। হরিণ শাবক ধরে আনতে পেরে রাজা নিজেও খুশি।
রাজপ্রাসাদটা বিশাল বড় একটা পুকুরের ঠিক মধ্যখানে। যাবার শুধু একটাই সুরু পথ। এখানে কেবল রাজা রানী আর রাজকুমারীই থাকে। কখনো কিছুর প্রয়োজন হলে একটা ঘণ্টা আছে তা বাজালেই একজন রাজ কর্মচারী ছুটে আসে। দুইটি ঘণ্টা বাজালে দুইজন ছুটে আসে।
রাজা প্রাসাদে এসে দেখল রাজকুমারী ঘুমিয়ে গেছে। এই অবেলায় কেন ঘুমিয়েছে তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে রাণীকে প্রশ্ন করল। রাণী ইঙ্গিত করল, আসলে সে ঘুমায়নি ঘুমের ভান করে আছে। রাজা জোরে হাসতে গিয়েও থামাল। তারপর একটু জোরেই বলল, ‘আমাকে এখনি বের হতে হবে রাণী। আমি চলে যাচ্ছি।‘
এই শুনতেই ছোট্ট রাজকুমারী ঘুম ফেলে দৌড়ে ছুটে এলো। রাজা ইচ্ছে করে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। ছোট্ট রাজকুমারী দৌড়ে এসে তার ছোট ছোট হাত দিয়ে রাজার এক পা জড়িয়ে ধরল। তারপর রাজার কোলে উঠে গেল এক লাফে। রাজা আর রাজকুমারী দুইজনই মহা খুশি। রাণী এসে বলল, ‘আরে তুমি না ঘুমিয়ে ছিলে রাজকুমারী?’
কেউ আর কোন কথা বলল না। তিনজনই হাসতে লাগল।
পরের দিন ভোরে রাজকুমারী চোখ মেলে দেখল একটা হরিন শাবক তার কাছাকাছি হেঁটে বেড়াচ্ছে। আর তার বিছানাটা ঘাসের উপরে। সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল সে রাজপ্রাসাদের চারদিকে যে খোলা জায়গাটা সেখানে শুয়ে আছে। আরে প্রাসাদ থেকে তাকে এত দূরে নিয়ে এসেছে সে টেরই পায়নি। সে অবাক চোখে চারদিক দেখে হরিণটাকে দেখতে লাগল।
এখানে অন্য কেউ নেই। রাজা রানী বা রাজকর্মচারীরা কেউ নেই। সে আর হরিণটা কেবল। হরিণটা ঘাস খাচ্ছে। রাজকুমারী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল।
সকাল পেরিয়ে গেছে। রাজা রানী ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমারীর কাছে এলো। রাজকুমারী দৌড়ে ছুটে গেল তাদের কাছে। রাজা রানী ঘোড়ার পিঠ থেকে নামাতেই রাজকুমারী বলল, ‘দেখ, দেখ বাবা হরিণটা কত সুন্দর!‘
রাজা হাসতে হাসতে বলল, পছন্দ হয়েছে?
‘হুম। অনেক অনেক পছন্দ হয়েছে।‘
ঘাসের উপরে বিশাল বিছানা। রাজা রানী এসে বসল সেখানে।
অনেক খন পরে রাজকুমারী নিরবতা ভেঙ্গে খুব ধীরে বলল,’ বাবা একটা কথা বলি?‘
রাজা বলল, ‘একটা নয় একশতটা বলতে পারো।‘
রাজকুমারী শান্ত গলায় বলল,’বাবা, ও তো অনেক ছোট। হরিণ বাবুটা ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঘাস খাচ্ছে কিন্তু কান্নাও করছে। ও কেঁদেছে বাবা, ও কেঁদেছে।‘ বলেই রাজকুমারী একটু চুপ হয়ে গেল।
রাজা রাণী কেউ কোন কথা বলল না। রাজকুমারী এবার কান্না জড়ানো গলায় বলল, ওকে দেখতে না পেয়ে হরিণ বাবুর আব্বু আম্মু কাঁদবে, তাই না বাবা?‘
রাজা এসে রাজকুমারীকে জড়িয়ে ধরল।
রাজকুমারী বলল, ‘গতবার তুমি যখন শিকারে গিয়েছিলে তখন তুমি যে অনেক দিন ছিলে না। আমার খুব কষ্ট লেগেছে তোমাকে না দেখতে পেয়ে। আমি একা একা অনেক কেঁদেছিলাম, এই হরিণ বাবুটার মতন। এই হরিণটার চোখে পানি, দেখো বাবা, দেখো। ও নিশ্চয়ই কষ্ট পাচ্ছে। পাচ্ছে না বাবা?’
রাণী বলল,’ আমার মেয়ে অনেক বুদ্ধি হয়েছে তো। আমি অনেক খুশি।‘
রাজকুমারী বলল, বাবা আমরা ওকে ফিরিয়ে দিতে পারি ওর বাবা মায়ের কাছে। তাই না বাবা?’
রাজার চোখে পানি চলে আসলো।