Home গল্প মুসা [পর্ব ১]

মুসা [পর্ব ১]

by Admin

মোঃ নোমান সরকার

মুসা খুবই বিরক্ত হয়ে বাসে উঠল। বৃষ্টিতে তার সার্ট প্যান্ট, জুতার অনেক খানি ভিজে গিয়েছে।  আজ চাকরি ইন্টারভিটটা দিতে আসতেই ইচ্ছে করছিল না। খামখা আসা। চাকরির সাথে ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নের কোন মিল নেই।

আজ বৃষ্টি আর জোরাল বাতাসের মাখামাখি। আজকের দিন ছিল কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকার দিন। মুড়ি, চানাচুর পিয়াজ ,ভাজা রসূন আর সরিষার তেল দিয়ে মাখিয়ে খাবার দিন। মেসে অবস্থা মুসার জানাই আছে। সারিষার তেল নেই, চানাচুর নেই, পিয়াজ ফুরিয়েছে,রসূন আছে সম্ভবত। মেস মেম্বার বলতে গতকাল থেকে সে একা। মোট তিন জন মিলে ছিল তারা মেসে অনেক দিন ধরে। হঠাৎ করেই দুইদিন আগে তারা একযোগে মেস ছেড়েছে। এ নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়েছে নিজেদের ভিতর। তিনজনের চমৎকার সম্পর্কটা কয়েক ঘণ্টায় বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিল। মানুষের সম্পর্কটা মানুষের চেয়েও আর বেশি অদ্ভুত আর জটিল। অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমনটা কখনো তার জীবনে ঘটেনি। মানুষ আসলেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শিখে। গল্প উপন্যাসে কত কথা এমন পড়েছে। অথচ এই অনুভূতি একেবারেই ভিন্ন। যেন নতুন ভাবে নিজেকে অবিস্কার করতে পেরেছে।

বাসে ৮/৯ জন পেসেঞ্জার। মুসা বাসের জানালার পাশে বসে আছে। বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টিতে বাস জায়গায় জায়গায় দাঁড়াচ্ছে অনেক সময় নিয়ে যাত্রী নিবার জন্য। এ নিয়ে সামনে বসা যুবকের সাথে বাস কণ্টেকটারের বার বার কথা কাটাকাটি হচ্ছে। মুসার এই সব ভাল লাগছে না। কিছুই ভাল লাগছে না। সে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। অথচ মনে হচ্ছে কিছুই দেখছে না।

বাস কন্টেকটারের চিৎকারে সে যেন অন্য কোথাও থেকে ফিরে এলো। বাস কণ্টেকটার তার সামনে বসা বয়স্ক লোকটাকে রীতিমত ধমকাচ্ছে। আজকাল মানুষের যে কি হয়েছে বয়স্ক মানুষের সাথে অনেক মন্দ আচরণ করে। তার বাবার বয়সী একজন মানুষের সাথে কি বেয়াদবি আচরণ করছে। মুসা বিরক্ত হয়ে বাস কণ্টাকটারের দিকে তাকল। তারপর বয়স্ক মানুষটির দিকে। লোকটার চাহনি, চুল কাঁটা , সার্ট দেখে রুচীরশীল মানুষ মনে হচ্ছে। আভিজাতের একটা ছাপ আছে চেহারায়। সেই বয়স্ক লোকটি বাস কন্টেকটার রীতিমত ধমকের সাথে কথা বলছে!

বাসের কণ্টেকটার বলছে , ভাড়া ১০ টাকাই। ৫ টাকা ভাড়া আমি নিব না, আপনাকে এই পর্যন্ত দশবার বলে গেছি। আরে বুঝেন না ক্যান আপনি আগে নামলে সমস্যা ছিল না। এখন কাউন্ট হয়ে গেছে, লেইখা দিচ্ছে কয়জন।

মানুষটা শান্ত ভাবে বলল,’আমার কাছে আর নেই। ৫টাকাওই আছে, এটাই নিতে হবে।’

‘৫ টাকা ভাড়া অনেক আগে ছিল। অনেক দিন হইছে ভাড়া বাড়ছে। ৫টাকা দিলে হইব না। আচ্ছা ঠিক আছে আপনি পরের ইষ্টেশনে আপনাকে নেমে যেতে হইব। বানানীর ভাড়া ১০টাকাই। এক টাকাও কম নিব না।

আমি নামব না। আমার কাছে তো ৫টাকাই আছে। তুমি বললেই হল, সামনের ইষ্টেশনে নেমে যেতে হবে। আমি নামব না। তোমাকে ৫টাকা দিলে, নেমে আমি কি হেঁটে যাব বানানী?  আর তুমি বললে, ভাড়া তো ৫টাকা ছিল। যখন খুশি বাড়াবে। মানুষের যে কষ্ট হয় এ নিয়ে কি তোমরা ভাব।’  

কন্টেক্টার অধরয্যের গলায় বলল,’আমি তার কি জানি। আপনি এই সব মালিককে কন। আমরা চাকরী করি। আর আপনাকে নেমে যেতেই হবে। আর না হলে ১০টাকা দিতেই হবে।’

‘আমি নামব না। ৫ টাকাই আছে আমার কাছে।’

‘নামতেই হবে। তা না হলে ১০টাকা দিতে হবে।’

বয়স্ক লোকটা খুব শান্ত গলায় বলল, ‘১০টাকা ভাড়া তো বেশি নিচ্ছ।’

বেশি নিব কেন? অন্য পেসেঞ্জারদের জিগান? এই যে নম্বর আছে ফোন করেন। 

হ্যা আমি ফোন দিব। আচ্ছা বললাম তো আমি ফোন দিব। ৫ টাকার ভাড়া ১০ টাকা বলছ। যখন তখন  ভাড়া বারাবে। বললাম ১০টাকা নাই ৫ টাকা আছে। ‘ বলে মোবাইল বের করল। মুসাও ভাবল উনি ফোন করবে। তিনি তা করলেন না। তিনি মবাইলে অন লাইনে গিয়ে ইংরেজীতে লেখা কিছু একটা পড়তে লাগলেন। মুসা চোখ সরিয়ে বাইরের দিকে তাকাল।

কন্টেক্টার সামনের দিকে গেল। মুসা আবার বয়স্ক লোকটার দিকে তাকাল, তিনি মনযোগ দিয়ে ইংরেজীতে লেখা আর্টিকেল বা এমন কিছু একটা পড়ছেন। মুসা বাইরের দিকে তাকাল। খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরে একটা ডিম আছে। একটাই আছে। ডিম দিয়ে ভাত খেতে ভাল লাগবে। মুসা আবার ভাবনার জগতে চলে গেল।

কন্টেকটারের চিৎকারে আবার সে ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলো।

‘আপনি এখানে নামেন।’

মুসা দেখল বাসটা থেমেছে।

‘আমি তো বলেছি আমি নামব না। আর বৃষ্টির মধ্যে আমি নামবই না।’

‘আরে আপনারে এই খানেই নামতে হইব। ১০ টাকা না দিলে আমি আপনারে যাইতে দিমু না। আছে আপনার কাছে টাকা। আর ফোন দিছিলেন?’

বয়স্ক মানুষটা কিছু বলল না।

‘আমি আগেই বুঝছি ফোন দিবেন না। বয়স হইছে, মিছা কথা বলইলেন না। ৫টাকার জন্য আপনি এমন করতাছে কেন, এমনিতেই পেসেঞ্জার নাই। আমার চাকরি থাকব না। গুওইনা গেছে ৯ জন পেসেঞ্জার।’

ড্রাইভার বলল, ‘বাবারে কেন খমকা ঝামেলা করতাছেন। গুনে গেছে ৯ জন। টাকা আপনাকে দিতেই হবে বাবা। দিয়া দেন তো।’

মুসা বুঝল ড্রাইভার কথা বলায় কন্টেকটার আরও বেয়াদবি করবে, মুসা ইশারা করল কন্টেকটারকে। হাত দিয়ে ইশারায় বুঝাল, বয়স্ক লোকটার থেকে টাকা নিবার দরকার নাই, আমি দিচ্ছি।

ইশারা করায় কণ্টেকটার যেন খেপে গেল। সে কিছুটা এগিয়ে এসে বলল, ‘আরে ভাই আপনি দিবেন কেন? আপনি কি উনার আত্মীয়? আর এতখন কৈ ছিলেন। এইখন ধইরা যে বকবক করলাম তখনই কইতেন টাকাটা আপনি দিবেন।’

মুসা বিরক্ত গলায় বলল,’ ভুল হতেই পারে। ম্যনিব্যাগে টাকা উঠাতে আমারই প্রতিদিন ভুল হয়। ৫০০টাকার জায়গা ১০০টাকা নিয়ে বের হই। এমন বিপদ আমারও অনেকবার হয়েছে। নাও ১০টাকা।’

বয়স্ক লোকটা বলল, ‘আরে আপনি কেন টাকা দিবেন? ৫টাকাই ভাড়া। ৫ টাকাই নিবে।’

কন্টেকটার আবার চিৎকার করে উঠে।

মুসা বলল, ‘টাকা পকেটে বা ম্যানিব্যগে নিতে ভুলে গেছেন হয়ত। সমস্যা নাই। আমার একবার এমন হয়েছে। আমার বাসের টাকা আরেকজন দিয়েছিল। আমি আজ আপনারটা দিলাম। আরেকদিন আপনি কার দিবেন। হয়ে গেল।’

কণ্টেকটার ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে গেল। বয়স্ক লোকটা উঠে মুসার পাশে এসে বসে বলল, ‘আমি বনানী যাব। আপনি? ‘

মুসা বলল, ‘আমিও বানানী যাব। একজনের সাথে দেখা করতে হবে।’

বয়স্ক লোকটা বলল, ‘আজকাল কেউ কার বিপদে এগিয়ে আসে না।’

মুসা বলল, ‘আমি এভাবে দেখি না। আমার মনে হয়, এগিয়ে আসার মানুষই বেশি।’

বয়স্ক মানুষটা বলল, ‘আমার বয়স হয়েছে। অভিজ্ঞতাও বেশি। আমি অনেক বেশি দেখেছি, আর অনেক বেশি দেখতেও পাই।’

মুসা বলল, জীবন হচ্ছে তাই, ‘যেভাবে আমরা দেখি, যেভাবে আমরা ভাবি, বুঝি। জীবন এর বাইরে না। দেখবার উপরই সবকিছু নির্ভর করে।’

বয়স্ক লোকটা অবাক গলায় বলল, ‘বাবা তোমার কথা আমাকে অভিভুত করল। কিছু মনে কর না, আমি তোমাকে তুমি বললাম।’

মুসা হেসে বলল, ‘আমি আপনার ছেলের বয়সী।’

বয়স্ক লোকটা বলল, ‘তোমার কথা ভালো লেগেছে। তা তুমি কোথায় থাক।’

মুসা বলল, ‘উত্তরখানে, উত্তরার পিছন দিকটায়।’

বয়স্ক লোকটা বলল, ‘হ্যা আমি চিনি। আরে আমরা অনেকখন ধরেই কথা বলছি। তা তোমার নাম কি?’

‘আমার নাম মুসা।’

‘আরে আমার নামও মুসা। মুসা বিন শমসের।’

‘নামটা খুব চেনা চেনা লাগছে।’

‘আরে হ্যা চেনা চেনা লাগবে না। এই নামে যে বাংলাদেশের সেরা ধনী একজন আছে। ভালোই লাগে নিজের নামের জন্য।’

মুসা হাসল। মুসা বিন শমসের। হ্যা মনে পড়েছে। তার নামেও নাম।

এর মধ্যে বনানী চলে এসেছে গাড়ি। বৃষ্টি থেমে গেছে। দুইজনই বাস থেকে নামবে। মুসা আগে নামল। আর মুসা বিন শমসের পরে। মুসা জানল না কি ঘটে গেল। সে উল্টো দিকে তাকাচ্ছে রাস্তা পার হতে হবে। মুসা বিন শমসের বাস থেকে নামার সময় কণ্টেকটারের হাতে চার ভাজ করা এক হাজার টাকার নোট দ্রুত গুজে দিয়ে নীচু গলায় বললেন, ফাজিল, বিপদে পরা বয়স্ক মানুষের সাথে এমন আচরণ করে? ৫ টাকার বেশি ভাড়া না দিয়া বনানী নেমে দেখতাম তুই কি করিস। আছার দিয়া তরে……।’ এই টুকু বলে তিনি নামলেন। নেমেই তিনি কণ্টেকটারের দিকে তাকালেন। কন্টেকটার হ্যা করে তাকিয়ে আছে হাতের নোটটার দিকে। কণ্টেক্টারের বিশ্বাসই হচ্ছে না কেউ তাকে এক হাজার টাকার নোট বকশিশ হিসাবে দিতে পারে, তাও তার খারাপ ব্যবহারের কারনে! তার সারা জীবনে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটতে দেখেনি।

মুসা বিন শমসের ডাকল মুসাকে। চল আগে রাস্তা পার হই। বলে দুইজনে রাস্তা পার হল। তারপর তিনি বললেন,’ তুমি আমার থেকে ১০টাকা পাও। সেটা এবার দিবার সুযোগ হয়েছে। চল আমি যে অফিসে কাজ করি। খুবই সাধারণ চাকরি। চল, এক কাপ চা ত খাওয়াতে পারব তোমাকে।’

মুসা বলল, না না এটা আর দিতে হবে না। আপনি বিপদে পরেছেন। এটা তো যে কার দায়িত্বের মধ্যেও পরে। আমি কাছে ছিলাম। আমি আসি। দেখা হবে আবার।’

আরে না না বলছ কেন? তুমি তো দিয়েছ। আমি ঋণে থাকবই বা কেন? তোমার তাড়া নেই তো? আরে আমার লাগবে ১০ মিনিট। প্লিজ।’

বয়স্ক মানুষ প্লিজ বলছে মুসা বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আমার তাড়া নেই। একজনের সাথে কেবল দেখা করা।’


You may also like

Leave a Comment