মোঃ নোমান সরকার
হরিণ একটা বিচার নিয়ে এলো বনের রাজা সিংহের কাছে। বনের রাজা সিংহকে সবাই সুবিচারক হিসাবেই জানে।
হরিণের অভিযোগ সাপের বিরুদ্ধে। সাপ বিশ্রী ভাষায় কথা বলে। কথা বলয়ার সময় ফোঁস ফোঁস করে গালি দেয়। খুবই বাজে সব গালি। যে কথায় কথায় অন্যকে গালি দিতেই থাকে। এত নোংরা সেই সব গালি যে শুনতে কষ্ট হয়। এই সব সহ্য করাটাই মুসকিল হয়ে গেছে। সাপের এই পচা কথা বলায় সবার কম বেশি এতে ক্ষতি হচ্ছে। শিশুরা খারাপ কথা শিখেছে। খারাপ গালি শিখছে। এতে বনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আর যে পচা ভাষায় কথা বলে, সে তো কারো বন্ধু হতে পারে না।
বনের রাজা সিংহ সব শুনলেন। তারপর খানিকটা হেসে বললেন, সাপ বিশ্রী ভাষায় কথা বলে, সেই বিচার হবে। কিন্তু তোমার মুখটা কেন মলিন হয়ে আছে। তুমি হরিণ। মলিনতা কি তোমাকে মানায়? আমি তো সব সময় হাসি খুশি থাক। আমার রাজ্যের প্রত্যেককে আমিবলি, নিজেকে হরিণ ভাবতে, হরিণের মতন হাসিখুশি থাকতে। আর সেই তুমি কিনা নিজেকে মলিন হয়ে আছ।’
এই কথায় হরিণ দ্রুত নিজেকে বদলে নিয়ে হেসে উঠল। তখন রাজা বলল, ‘দেখতো আকাশটাকে। তুমি হাসতেই আকাশ কি ঝকঝকে হয়ে গেল।’ সেই কথা শুনে হরিণ আকাশের দিকে তাকাল। তার হাসিটা আরো বেড়ে গেল।
বনের রাজা সিংহের সাথে আরো কিছু কথা হল। রাজা হরিণকে কিছু দিন অপেক্ষা করতে বললেন আর একটা তারিখ দিয়ে হরিণ, সাপকে আসতে বললেন, আর বনের সবাইকে।
অনেক দিন পর একটা অভিযোগ এসেছে। বহুকাল এই বনে কেউ কারো বিরুদ্ধে কথা বলেনি। কোন অভিযোগ নেই। সবাই শান্তিতে এই বনে বসবাস করে।
শেষ বিচারটা হয়েছিল মাছির বিরুদ্ধে। হাতি মাছির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল, মাছি কেবলই সমালোচনা করে। কথায় কথায় অন্যের দোষ ধরে আর সমালোচনা করে। এই নিয়ে সারাক্ষণ ভন ভন করে। ভনভন করতে করতে এর কাছে যায়, তার কাছে যায়। এর কথা তাকে বলে। তার কথা আরেকজনকে বলে বেড়ায়। ফলে ঝগড়া লেগে গিয়েছিল অনেকবার। শেষে একদিন এই নিয়ে হাতি অভিযোগ তুলেছিল রাজার কাছে। অভিযোগ পেয়ে বনের রাজা সিংহ অনেক ভাবলেন। তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝলেন আর ভেবে দেখলেন, দুষ্ট কখনো ভাল হয় না। আর মন্দকে ভাল করতে গেলে যে ভালো, মন্দের সাথে মিশে সেও মন্দ হয়ে যায়। তাকে এড়িয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবুও রাজা মাছিকে সুযোগ দিল। কিন্তু সুযোগ পেয়ে লাভ হয় না। মাছি যেমন ছিল তেমনই রইল।
সিংহ এরপরে রায় দিল,’ তাকে সবাই এড়িয়ে চলবে।’ আর সেই থেকে মাছি এলেই সবাই তাকে তাড়ায়। সে কারো গায়ে বসে আরাম পায় না। সবাই রেগে তাকে তাড়িয়েই দেয়। তাই সে পালিয়েই থাকে। কারো সামনে সহজে আসে না।
অবশেষে সাপের বিচারের সেই তারিখ এলো। সকাল বেলা রাজসভার শুরু। হরিণ আর সাপ এসেছে। এসেছে প্রত্যেক প্রাণী। অভিযোগ খুবই গুরুতর।
বনের রাজা সাপকে প্রশ্ন করলেন, কি হে এত অভিযোগ কেন তোমার বিরুদ্ধে?’
সাপ উত্তর দিল, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সবই মিথ্যা। তবে হ্যা আমার রাগ বেশি। তাই কিছু কথা রেগে গিয়ে বলে ফেলি। এর বেশি কিছু না।‘
সিংহ হাসলেন। তারপর হেসে হেসে বললেন, ‘তুমি তো কথা বলছ গুছিয়ে, সুন্দর ভাবেই। তাই না?’
সাপ বলল, ‘এই ইতরগুলো আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। এরা উল্টো আমাকে যা ইচ্ছা তাই বলে। এদের সবগুলোর উপর প্রতিশোধ নিব। সবগুলোকে কামড় দিয়ে কাটব।’
সিংহ গম্ভীর হয়ে বলল,’আরে তুমি যে ভুলেই গেছ তুমি রাজার সামনে দাঁড়িয়ে। তুমি আচ্ছা পাঁজি তো! তুমি রাজার সামনে কথাগুলো বলছ!’
সাপ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘আমার রাগ বেশি। রেগে গেলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তাই তাদের গালি দেই। গালি দিতে দিতে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।’
রাজা বললেন, সেটা নিয়ন্ত্রণ করার জাদু আমার কাছে আছে। তুমি এই সব নিয়ে ভেব না। সেই জাদু দেখার পর তুমিও নিয়ন্ত্রত হবে।’
বনের রাজা বললেন, এই যে তুমি আমার সামনেই তাদের প্রতিশোধের কথা বললে, এতে এখানে উপস্থিত সবাই আঘাত পেয়েছে বা পাচ্ছে, এটা কি তোমার মনে হচ্ছে না? এমন করে কথা তমাকে বললে তুমি কি আঘর পাবে না, তুমি কি কষ্ট পাবে না? সেটা কি তোমার ভালো লাগবে?
সাপ চুপ করে আছে।
রাজা বলল, ‘তুমি কি মনে কর না, এগুলো পচা কথা?’
সাপ চুপ করে আছে।
বনের রাজা বলল, তোমার পচা কথায় কেউ আঘাত পাচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে, এটা যে বড় এক বিষয় তা কি তোমার মনে হচ্ছে না? দেখত তাকিয়ে প্রত্যেকের চেহারার দিকে?
সাপ কারো দিকে তাকাল না।
বনের রাজা বলল, কথা দিয়ে বন্ধুত্ব হয়। আবার কথা দিয়েই বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। কথা দিয়ে কাউকে হাসানো যায়। আবার কথা দিয়েই কাউকে আঘাত করা যায়। এর মানে কি? এর মানে হল, কথা বলার সময় আমরা কোন কোন শব্দ বেছে নিব তার উপর কথার সৌন্দর্য বাড়ে বা কমে। আর তুমি কথা বলার সময় শক্ত শব্দগুলো বেছে নাও, খারাপ শব্দগুলো বেছে নাও। ফলে তোমার কথায় সবাই মন খারাপ করে, কেউ আঘাত পায়। তুমি কি তোমাকে বদলাতে চাও না?
সাপ কোন কথা বলল না।
বনের রাজা বলল, তুমি যদি নিজেকে সবার বন্ধু মনে কর, তবে সবার কাছে ক্ষমা চাও। ভুল হতেই পারে। কি ভুল হতে পারে না?
সাপ কোন কথা বলল না। তাকাল না।
রাজা বলল, ভুল করা থেকে সব শিখা যায়। নিজেকে বদলে নেওয়া যায়। আর প্রমিজ কর, নিজের কথা বলাটাকে ঠিক করে নিবে। মন্দ শব্দগুলো এড়িয়ে যাবে। বকা দিবে না। পচা কথা বলবে না। দেখবে তখন সবাই তোমার বন্ধু হয়ে যাবে।
সাপ এবার রাগী গলায় বলল, আমি কাউকে পচা কথা বলি না, কষ্ট দেই না। আঘাত করে কথা বলি না। হরিণ আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে।’
বনের রাজা সিংহ একটা হুংকার দিল। সাপ সহ সব প্রানীরা ভয় পেয়ে গেল। সিংহ বলল,’ তুমি তো কেবল মন্দ না। তুমি মিথ্যাবাদীও। তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ। আর তুমি উল্টো অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছ! ভয় দেখাচ্ছ, শাসাচ্ছ যে তাদের কামড় দিয়ে কাটবে। আর সেটা বনের রাজার সামনে। তুমি বলছ, তোমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলছে? মিথ্যা অভিযোগ করছে? তুমি কি মনে কর, আমি অভিযোগ শুনেই তোমাকে ডেকেছি। আমি বনের প্রায় সবার কাছে তোমার বিষয় খোঁজ নিয়েছি।’ বলে রাজা থামলেন।
চারদিকে সবাই চুপ। কোথাও কোন শব্দ নেই। একটা নিরবতা গ্রাস করেছে সবাইকে। সেদিকে তাকিয়ে বনের রাজা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,’যে মিথ্যা বলে, সে তো যে কোন খারাপ কাজ করতে পারে। অন্যকে কষ্ট দিতে পারে। কষ্ট দিয়ে সে বলতেই পারে, আমি এই কাজ করিনি। এতে ঘটনা খারাপের দিকে যায়। ঝামেলা বাড়ে। সমাজ নষ্ট হয়। কিন্তু যে সত্যবাদী মিথ্যা এড়িয়ে চলে। সে তার দোষ বা ভুল স্বীকার করে। এতে সহজ হয়ে যায় সবকিছুই।‘
সাপ বলল, ‘রাজা আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। আমি মিথ্যাবাদী নই।‘
রাজা হুংকার দিয়ে বলল, ‘ অভিযোগ সত্য কিনা তা যাচাই করতে বনের সবার সাথে কথা বলেছি। সবাই একই কথাই বলেছে। রাজ্যের অধিকাংশই তোমার এই গালি দিবার বিষয় আর বিশ্রী ভাবে কথা বলার বিষয়টা আমাকে জানিয়েছেন।তুমি সারাক্ষণ পচা কথা বল। এবার বল মিথ্যা কে বলছে? তুমি নাকি বাকী সবাই? ‘
চারদিকের নিরবতা আরো বাড়ল। সবাই কঠিন শাস্তি আর ন্যায় বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে।
বনের রাজা সিংহ আরো জোরে তার রায় ঘোষণা করল, ‘সাপকে সবাই এড়িয়ে চল।’
আর সেই থেকে সাপ একাই চলে। কেউ তার সাথে কথা বলে না। তাকে দেখেও না দেখার ভান করে। তবুও সাপ বিশ্রী ভাবে কথা বলা ছাড়তে পারেনি। পচা কথা সে বলেই যায়। সে ফোঁস ফোঁস করে গালি দেয় সবাইকে দূর থেকে।
সে নিজেও বুঝে, যে নিজেকে মন্দ বানায় সে মন্দই থাকে। সে কারো বন্ধু হতে পারে না।