মোঃ নোমান সরকার
রাজা শিকারে গেলেন । অনেক সৈন্য তার সাথে । তিনদিন পর রাজা যখন শিকার শেষে করে ফিরে আসবেন তখন তিনি সৈন্যদের থেকে জানলেন বনে একটা অনেক বড় হরিণেরর ঘুরে বেড়ানোর কথা।
রাজা সবাইকে জানালেন ,’’ আমার সঙ্গে কারো আসার প্রয়োজন নেই। তোমরা এগিয়ে যাও। আমি পরে তোমাদের সাথে যোগ দিব। আমি একাই হরিণটাকে ধরব।”
সৈন্যরা সবাই চলে গেলে রাজা বের হলেওন হরিণটাকে খুঁজ বের করতে। আর রাজা ঠিকই খুঁজে বের করলেন হরিণটাকে।
বহু দূর থেকে দেখলেন হরিণটা নদীর ধারে পানি পান করছে । রাজা ঘোড়াটা একটা গাছের সাথে বেঁধে তিনি অনেকটা পথ হেঁটে হরিণটার কাছাকছি চলে এ্লেন। একটা বড় গাছের আড়ালে এসে দাঁড়ালেন। তারপর তীর ধনুক ঠিক করে তাক করলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন প্রাণীটার পানি পান শেষ হওয়া পর্যন্ত। খুব তৃষ্ণার্ত হরিণটা। পানি পান যেন শেষ হচ্ছে না। বড় আরাম করে পান করে যাচ্ছে। রাজা অনুভব করলেন যেন সেই তৃষ্ণা মেটানো আরাম বোধটা হরিণের সাড়া অন্তর জুড়িয়ে দিয়ে গেল। তিনি ঠিক করলেন , অপেক্ষা করবেন । প্রানীটা পানি পান করে আগে ওখান থেকে উঠে আসুক । তিনি তাকিয়ে দেখতে লাগলেন হরিণটাকে। কিন্তু বিশাল বড় হরিণটাকে দেখতে দেখতে তিনি মায়ায় ডুবে গেলন যেন। তিনি অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলেন সুন্দর হরিণটাকে। অনেক সুন্দর হরিণটাকে তিনি মারবেন না বলে ঠিক করলেন। তিনি তীর ধনুক কিছুটা নামিয়ে নিলেন।
ঠিক এমন সময় ঘটল ঘটনাটা। রাজা শুনতে পেল তার নিজের ঘোড়াটার চিৎকারের শব্দটা ! রাজা দেখল হরিণটাও যেন শুনতে পেয়েছে । পানি পান করা ছেড়ে ভয়ে সে শব্দের উৎসের দিকে তাকাল। রাজা দ্রুত ধনুকটা পিঠে ঝুলিয়ে ঘুরে দাড়িয়ে ছুটল পিছন দিকে। তিনি বুঝতেই পারেননি এতটা দূরে চলে এসেছেন ঘোড়াকে বেঁধে রেখে। যখন তিনি ফিরলেন ঘোড়া রেখে যাওয়া জায়গাটায়। দেখলেন বেশ কিছু মানুষ মিলে একটা ঘোড়ার গাড়ীতে করে তার প্রিয় ঘোড়াটা উঠিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে ! অনেক দূরে চলে গেছে তারা। তিনি পিছু পিছু দৌড়ে গেলেন। কোনই লাভ হলনা। দ্রুত চলাঘোড়া গাড়িটা বাতাসে যেন মিলিয়ে গেল।
একদিন কিংবা তারও বেশি রাজা জিনজির হাঁটলেন। ক্লান্ত , ক্ষুধার্ত হয়ে তিনি সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেললেন। তারপর দেখলেন অতি দূরে একটা কুঁড়ের ঘর। ঘর দেখা মাত্র ক্ষুধা যেন বেড়ে গেল। তিনি কখনই এভাবে কষ্টকে দেখেননি , করেননি । তিনি বারবার বললেন ,’’হে আল্লাহ, এই পরীক্ষায় আমাকে শক্তি দাও।”
তিনি যখন কুঁড়ের ঘরটার দরজায় ধাক্কা দিলেন। তা সহজে খুলে গেল। আর তিনি ভারসাম্য রাখতে না পেরে ঘরের ভিতর পরে গেলেন ,জ্ঞান হারালেন। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলেন অনেক মানুষ চারদিকে। আর দুইজন মানুষ তার মাথায় পানি দিতে। তিনি ইশারায় পানি পান করতে চাইলেন। একটা ছোট ছেলে পানি আর খাবার নিয়ে এল । গোগ্রাসে তা খেতে খেতে মনে রাজার মনে হল , তিনি নিজের প্রাসাদেই আছেন !
ছেলেটি থেকে রাজা জানালো , তাদের কাছের এক গ্রামে অনেক দুষ্ট লোক বাস করে। দুষ্টরা তাদের ঘরের ধান নিয়ে গেছে। ওদেরও অভাব। আর আমাদেরও অভাব। কিছুদিন আগে তাদের দুইটা ঘোড়া ছিল তাও নিয়ে গেছে। রাজা মনে মনে ভাবলেন, এই আমার সোনার দেশের অবস্থা ! রাজা ছেলেটার কাছে সব শুনে বলল ,বাবা তুমি চিনবে ওদের এলাকাটা?”
তখন ছেলেটা মাথা নেড়ে ‘হ্যা’ বলল।
রাজা বলল ,তোমার বাবা মা তোমাকে কি নামে ডাকে ? ছেলেটা তার ফোকলা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল ‘’ ছোট রাজা।” রাজা খুব আনন্দ পেলেন। অতান্ত মিষ্টি করে ডাকলেন ,’’ ছোট রাজা !”
পরের দিন রাজার মনে হল তিনি সুস্থ । তিনি গেলেন ছোট রাজাকে নিয়ে পাহারের ওপাশের গ্রামটায়। গ্রামে ঢুকতেই রাজা তার বিশাল তরবারিটা নিয়ে হাত উঁচিয়ে হাটতে লাগল । ধীরে ধীরে লোকজন জমে গেল অনেক । রাজা দেখলেন লোকদের ভিড়ে সেই চোরদেরও ।
রাজা এক জায়গায় এসে থামলেন। ততোখনে অনেক মানুষ জমে গেছে। রাজা বললেন ,তোমরা তরবারি দেখে বুঝেছ ,আমি সাধারন লোক নই। আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের বিপদের কারণ হয়ে এ গ্রামে ঢুকতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি।” রাজা থেমে চোরদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের মধ্যে যে আমার প্রিয় ঘোড়াটা আটকে রেখেছ ,তাদের আদেশ করছি ঘোড়াটা ফিরিয়ে দিতে । আর এই ছেলেটার বাবা মাকে ফিরিয়ে দিতে । আমি তাদের হয়ে তোমাদের সব পাওনা মিটিয়ে দিব।’
খুব দ্রুতই আরও অনেক মানুষ চলে এলো। এক বৃদ্ধ ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন। তিনি রাজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন ,‘’দুই দিন আগে আমরা এ গ্রামে একটা রাজকীয় ঘোড়া দেখতে পেয়েছি ,আজ তার মালিককে দেখতে পেলাম । আপনার ঘোড়া , তরবারি , বাজু আর ঘাড়ের কাল জন্ম দাগটাই বলে দেয় আপনি আমাদের রাজা !” একটু থেমে বৃদ্ধ মানুষটা ঘুরে ভিড়ের মধ্যে কথা বলা বলি করা মানুষদের দিকে তাকিয়ে অনেক জোরে চিৎকার করে বলার ,’’আমরা আমাদের রাজাকে আমাদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি !”
এ কথা হতেই চারদিক নিরব হল। একেবারে নিরব ! রাজা জিনজির অবাক বিস্ময়ে দেখলেন , অনেক অর্ধহারী ,অনাহারী, অর্ধ উলঙ্গ বঞ্চিত মানুষ একত্রে অবাক বিস্ময়ে তার দিকে গভীর মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে ! তিনি অনেক কষ্ট নিয়ে চারদিকের মানুষগুলোর দিকে তাকালেন ! তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরল । তিনি কেবলই মনে মনে ভাবলেন ,হায় আমার প্রজা ! একি অবস্থা আমার প্রজাদের। আর এদিকে আমি প্রাসাদ আর শিকার নিয়ে আছি! এই দুরবস্থা আমার প্রজাদের। এই আমার সোনার দেশ! আমার দেশ!