মোঃ নোমান সরকার

আজকের শিশু কিশোরদের কাছে এই তথ্য হয়ত থাকতে পারে যে, মানুষের এই সুন্দর শরীরের ৬০% থেকে ৭০% পানি দিয়েই তৈরি। এমনকি হাড়, মস্তিস্ক,পেশির বিশাল অংশ পানি দিয়ে তৈরি। সুস্থ শরীরের জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন। পানি কেবল তৃষ্ণা মিটানোর বিষয় কেবল না, এটি পানির মাত্রা ঠিক রেখে অতিরিক্ত ক্যালরি পুড়তে সাহায্য করে। পানির অভাব বা ঘটতি হলেই তাই বড় বিপদ।
কিন্তু শিশু কিশোরদের কাছে এই সব তথ্যগুলো থাকলেও এই বিষয়গুলো পারিবারিক ভাবে অভ্যাস না গড়ে তোলার কারনে বা পানি পানের নিয়মগুলো নিয়ে পারিবারিক ভাবে আলোচনায় ন আসায় বা এই নিয়ে পারিবারিক শিক্ষা না দিবার কারনে আমাদের সঠিক নিয়মে বিশুদ্ধ পানি পান করার অভ্যাস গড়ে উঠেনি। মনে রাখতে হবে পানি যদি বিশুদ্ধ না হয় বা যে পাত্রে পানি পান করা হচ্ছে তা যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না হয় তবে বিশাল বড় বিপদের কারন হতে পারে। এই বিষয়টি সঠিক নিয়মে বিশুদ্ধ পানি পানের মতনই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এই নিয়ম বা অভ্যাসকে মূল্য দেয় না। ফলে নানান জটিলতার জন্ম হয় ধীরে ধীরে। শরীরকে আমরা মেশিনের মতন ভেবে নিতে পারি। নিয়ম বা অভ্যাসটা এমন ভাবে মুল্য দিতে হবে যেন নিজের প্রতি যত্নের মতন বিষয়টি দাঁড়ায়। যত্নই পারে এই শরীরকে সুস্থ রাখতে। সঠিক নিয়মে পানি পান করাটা শরীরের জন্য তাই অনেক বিষয়।
চুমুক দিয়ে ধীরে ধীরে পানি পান করতে হবেঃ আয়ুর্বেদে আছে, চুমুক দিয়ে দিয়ে পানি পান করাটাই সর্বোত্তম উপায়। আমাদের মুখে প্রচুর লালা থাকে। তাড়াহুড়া বা ঢক ঢক করে বা একবারে পান করলে অথবা পানি গিলে খেলে এই লালা পাকস্থলিতে পৌছাতে পারে না। ফলে আমাদের পেটে হাইড্রলিক এসিড আছে তা কার্যক্ষমতায় তারতম্য দেখা দেয়। তাই ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে পানি পান করতে হবে। খেয়াল রাখবেন পানিটা যেন অল্প সময়ের জন্য মুখের ভিতরে থাকে, লালা যেন পানির সাথে মিশাতে পারে, জিব্বা ভালো করে ভিজে। হাদিসে এসেছে কমপক্ষে তিন শ্বাসে পানি পান করতে হবে এবং শ্বাস ছাড়ার সময় পানির পাত্র মুখ হতে সরিয়ে নেওয়া। [যাতে শ্বাস পানিতে না পরে।] [বুখারী শরীফ]
দাড়িয়ে পানি পান করাঃ আয়ুর্বেদে আছে, দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের বিভিন্ন হাড়ের সংযোগস্থল ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং আরথ্রাইটিস রোগে ভোগার সব চেয়ে বড় কারণ। দাড়িয়ে ঢক ঢক করে পানি পান করলে পানি সরাসরি চলে যায় পাকস্থলীতে এবং দ্রুত প্রসাবের চাপ বাড়ে। এতে কিডনির ক্ষতি হয়। নার্ভ প্রদাহের ক্ষতি হয় এবং ক্ষতি হয় অক্সিজেন সরবরাহের। বসে পানি পান করলে হজম ক্ষমতার ঠিক থাকে। নার্ভাস সিষ্টেম ঠিক থাকে। ফলে অবসাদ, উৎকণ্ঠা, মলিনতার সমস্যা জটিল হয় না।
কখন তৃষ্ণা পেয়েছে এটি বুঝতে হবে এবং গুরুত্ব দিতে হবেঃ গরমে ঘামের সাথে শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায়। তাই এই সময় প্রচুর পানি পান করতে হবে। আবার শীতে ঘাম হয় না। তাই পানি কিছুটা কম হলে সমস্যা হয় না। গবেষকরা জানিয়েছেন, পানির ঘাটতি দেখা দিলে প্রাকৃতিক ভাবেই আমরা তৃষ্ণা অনুভর করি। আর গলা শুকিয়ে যাওয়া, ঠোঁট শুকিয়ে যায়। এটা ছাড়া প্রসাবের রং দেখে বুঝা যায় শরীরের পানির ঘাটতি আছে কিনা। যদি প্রসাবের রং হলুদ, কমলা বা লাল হয় তবে বসে ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে প্রচুর পানি পান করতে হবে। অধিকাংশ এই বিষয়টি শিশুরা জানে না। তাই তাদের বলে বুঝাতে হবে। প্রসাব যাতে দেখে এ নিয়েও তাদের সাথে কথা বলতে হবে। ফলে পানি পানের জরুরী বিষয়টি তারা বুঝে ফেলবে।
সময়ঃ সকালে ঘুম থেকে উঠে চেয়ারে বসে খালি পেটে বা বাসি মুখে তাড়াহুড়া না করে ধীরে ধীরে ১/ ২/৩ গ্লাস গ্লাস পানি পান করলে সারা রাতের মুখের জমে থাকা লালা বা ক্ষার পাকস্থলীতে গেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আর দিনের বেলায় তাপের কারনে ঘাম হয়। তাই দিনের বেশি করে পানি পান করাটা উত্তম। গবেষকরা বলেন ব্লাডপেসার নিয়ন্ত্রণ রাখতে গসলের আগে এক গ্লাস পানি পান করতএ হবে এবং স্ট্রোক বা হার্ট এট্যাক এড়াতে ঘুমের আগে এক গ্লাস পানি পাওন করতে হবে। মনে রাখতে হবে স্কুল কলেজে যাবার জন্য রেডি হবার অনেক আগে মানে ঘুম থেকে উঠেই পানি পান করতে হবে। এতে সবচেয়ে বড় সুবিধা পেটে জমে থাকা সব ময়লা সহজে বেরিয়ে যেতে পারবে। পেটের নানান রোগ থেকে নিরাপদ থাকা যাবে।
কতটুকু পানি পান করতে হবেঃ বড়দের সারা দিনে ২ লিটার, মানে ৮ গ্লাস। সেই অনুযায়ি ছোটদের পানি পান করতে হবে। দিনের বেলায় বেশি করে। ঘামলে মনে করে বেশি পানি পান করতে হবে। গরমের দিনে বেশি করে পান করতে হবে ধীরে ধীরে।
খাবারে আগে না পরেঃ ভুলেও খাবারের সাথে বা পরপরই পানি পান করা উচিৎ না। এর বৈজ্ঞানিক কারন আছে। গবেষকদের মতে এতে হজমে সহায়ক পাচক রসের কার্যক্ষমতা ব্যাঘাত ঘটে। বদ হজম আর গ্যাসের সমস্যা বাড়ে। তাই নূন্যতম খাবারের আধা ঘণ্টা আগে পানি পান করা উচিত আর খাবারের নূনুতম আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পরে পান করা উচিৎ।
ঠান্ডা নাকি গরম পানিঃ নিয়মিত ঠান্ডা পানি পেটের চর্বিগুলো শক্ত করে ফেলে। আর নানান রোগ ডেকে আনে। আর গবেষকরা বলছেন কুসুম কুসুম গরম পানি হজম ক্ষমতা সহ অনেকগুলো উপকার ঘটে শরীরের। সকালে নাস্তার আগে কুসুম কুসুম গরম পানি আর সাথে আমরা লেবুর রস মিশিয়ে নিলে তো অনেক বেশি উপকারে আসে শরীরের। তেমনি রাতে শোবার আগেও কুসুম কুসুম গরম পানির অভ্যাস করতে হবে। এতে টনসিলের সমস্যা সহ গলার ভিতরে সব সময় আরাম পাবে। তাই ঠান্ডা পানির অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। ঠান্ডা পানি মানেই অনেক রোগের মা। খাবার না খেয়ে যেমন কেউ মরে যায় না। তেমনি ঠান্ডা পানি পান না করলেও কিছু হয় না। এটি একটি অভ্যাস। শরীরকে, কন্ঠনালী, ফুসফুসের জন্য আমাদের এই কথাটি মাথায় রাখতে হবে।
ফল আর শাক সবজিঃ কাঁচা ফল- মুল এবং শাক- সবজিতে প্রচুর পানি থাকে। তাই সকালের নাস্তার আগে , দুপুরের খাবারের আগে, বিকালের নাস্তায় বা আস্তার আগে আর রাতের খাবারের আগে আমাদের নিয়মিত সালাদ খেতে পারলে খুবই ভালো। কাঁচা ফল- মুল এবং শাক- সবজির সালাদ খেলে পেট ভরে যায়। ফলে ভাত সহ অন্য সব ভারী খাবার কম খাওয়া হয়। এতে স্বাস্থ্য অনেক অনেক ভালো থাকে।
বেশি বেশি পানি পানে আমরা যত্নবান হয়ে নিজের শরীরকে চাপ মুক্ত রাখি। মনে রাখতে হবে, আমি হচ্ছি আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। আমার দেহই আমার নানান সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করে। আর শরীর ভালো রাখতে একটা নিয়মের ভিতর নিজেকে নিয়ে আসতেই হবে। পানি পানে আরো যত্নবান হলে এই নিয়মের ভিতরে আসা সহজ হয়ে উঠবে।