মোঃ নোমান সরকার
তাকে দেখে আমি খুশিতে এতই আত্মহারা হয়েছিলাম , নোমান।
আমার হৃদয়ের ভগ্নদশা যা দেখাতে আমি যুগ অপেক্ষায় ছিলাম, তাই প্রকাশ করা হল না।।
[১]
নোমান প্রেম তোমাকে কোথায় নিয়ে গে্লো! প্রেমই যে আমাকে শিখালো এই জগতে নজরটাই বড়। মনজিলই সে, আমিও সে। এ এমন এক অন্ধকার যেখানে না নিজেকে দেখা যায়, না গোটা দুনিয়া। সারা জাহান যেমন অন্ধকারে ডুবে আছে , প্রেমও তেমন। সর্বত্রই সে আর সে। আমি যেটুকু পেয়েছি সেটুকুর জন্য শুকরিয়া। আর যেটুকু পাইনি সেটুকুর জন্যও।।
[২]
নোমান, পিছনের হিসাব দেখতে চেও না। থাক। থাক না ওসব। যা তুমি পাওনি, তা আল্লাহই তোমাকে দিয়েছেন। আর যা তুমি পেয়েছ, তাও আল্লাহই তোমাকে দিয়েছেন। তাই যা পাওনি তার জন্য আফসোস করো না। আর যা পেয়েছ তার জন্যও না।।
[৩]
দুয়ারে দুয়ারে যে পৌছে যেতে জানে না, তার নিজের যত গল্পই থাক, তা কখনো অন্যদের কাছে প্রকাশ হয় না। আর তুমি তাকে মাতালও বলতে পারো, নোমান। কেননা প্রত্যেক স্বাদ সৃষ্টিই হয় অনেকগুলো মসলা ব্যবহারের পরিমাপের গুনে।।
মোঃ নোমান সরকার
রাজকুমারী দেখতে পেল একটা মানুষ পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। রাজকুমারীর মন ভাল ছিল না। সকালে সখীদের নিয়ে সে এসেছিল নদীর পারে। নদীর পারে এসেই মনে হল, একা থাকলেই তার ভালো লাগবে। তাই সে সবাইকে দূরে চলে যেতে বলল। জায়গাটা ছোট্ট একটা টিলার পাশে। আরো দূরে টিলার উপরের দিকে তার জন্য বিশেষ দেহক্ষীরা আছে। একটা পালকিতে চড়েই প্রতিবার এই জায়গাটায় সে আসে। কেন যেন খুব ভাল লাগে জায়গাটা।
রাজকন্যা খুব জোরে ডাকল,’ মিথিলা! মিথিলা!’
ডাক শুনতেই মিথিলা দৌড়ে এলো।
আমার দেহরক্ষীদের ডাকো। দ্রুত।
মিথিলা প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে উপরে উঠে গেল। আর যেন বাতাসের গতিতে দেহরক্ষীরা হাজির হল।
রাজকুমারী কঠিন গলায় বলল,’ঐ মানুষটারে টেনে নিয়ে এসো। মানুষটা ডুবে যাচ্ছে।‘
আট জনের জায়গায় তিনজন দেহরক্ষী পানিতে ঝাঁপ দিল। এই সময়টায় স্রোতের গতি বেশি হয়। তারা ছুটল মানুষটার দিকে প্রচন্ড ক্ষিপ্ততায়। অবশেষে মানুষটাকে নদীর পানি থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো।
রাজকুমারীর সামনে মানুষটাকে শুয়ে দেওয়া হল। মানুষটার দুই হাত বাঁধা।
রাজকুমারী বলল, ‘ওকে হাকিমের কাছে নিয়ে যাও। এখনই। আমার পালকীটা নিয়ে যাও। ঢেকে নিও। যেন কেউ বুঝতে না পারে। আর হাকিম সাহেবকে আমার সালাম দিবে। যাও।‘
দুইজন শক্ত দেহরক্ষী ছুটোল মৃত প্রায় মানুষটাকে নিয়ে।
[২}
২ দিন পর মানুষটা বেশ সুস্থ বোধ করছে। তাকে মেরেই ফেলেছিল। হাত বেঁধে পানিতে ফেলে দিয়েছিল। ভালো সাঁতার জানার পরেও স্রোতের টানে সে মরেই যাচ্ছিল। কেউ একজন তাকে বাঁচিয়েছে । তবে কেউ বলতে পারে না, সে কে!
আরো ২ দিন কাটল। তারপর হাকিমের কাছে বিদাই নিয়ে সে কড়া রোদে হেঁটে যেতে লাগল। তাকে যেতে হবে বহু উত্তরে। যদিও যাওয়াটা ঠিক হবে না।
এক অশ্বরহী তার পথ আটকালো। তারপর আরো তিনটি অশ্বরহী।
আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।‘ একজন বলল।
অশ্বরহীর গলার সুর রুক্ষ হলেও চড়া না। তারপর সম্মান দিয়েই কথা বলছে বলেই মনে হল। কিন্তু এদের সাথে যাওয়া কি ঠিক হবে। যদিও সে নিশ্চিত এখানে কেউ তাকে চিনে না।
আমাকে কোথায় যেতে হবে, আমি কি তা জানতে পারি?
না আপনাকে তা বলা যাচ্ছে না।
আমার জানতে ইচ্ছে করছে।
একজন নেমে এলো নীচে। বিষয়টা আমরা নিজেরাও জানি না।
একটা ঘোড়া দেওয়া হল। মানুষটা উঠে বসল তাতে। তিন বার ঘোড়া পরিবর্তন করা হল তিনটা আলাদা আলাদা ফাঁকা জায়গায়। বিষয়টা ভালো লাগছে না।
একটা জঙ্গলের কাছাকাছি আনা হল তাকে। নামতে বলা হল। সে নামল। অন্য তিন অশ্বরহীরাও নামল। তারপরই আচমকা তার মুখে একটা ঘুষি পড়ল। সে ভেবে পেল না কি ঘটছে।
নিজেকে সামিলে নিতে তার একটু সময় নিল। ততক্ষনে বেশ কিছু কিল ঘুষি খেয়ে নিতে হয়েছে তাকে। যখন সামলে নিল, তখন সে ল্যাঙটা মারল কাছের জনকে। তারপরেই সে উড়ে গেল দ্বিতীয় জনের দিকে। তৃতীয় জনও রক্ষা পেল না তার হাত থেকে। যতটা ঘুষি তাকে হজম করতে হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ ফিরত দিতে পারল ওদের। আর তখনই আরেকটা অশ্বরহী বিশাল এক তরবারি হাতে এগিয়ে এসে থামল। খুব শক্ত গলায় বলল, ‘থাম যুবক।‘
মানুষটা থামল।
মোঃ নোমান সরকার
ছোট ভুতটি শব্দ করে কাঁদছে। বনের সব প্রানী, পাখির আর ছোট ছোট প্রান যারাই আছে তারা সবাই ভয়ে কাঁপছে। কারন একটাই এই ছোট ভুতটির মা খুবই ভয়ংকর। সে রেগে গেলে যাকে কাছে পায় তারই ঘাড় ভেঙ্গে দেয়। বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ, ঈগল, পিপীলিকা কেউ ভূতের কাছ থেকে রেহাই পায়নি।
ছোট ভূত মাকে খুঁজে পাচ্ছে না বলেই কাঁদছে।
বনের সব প্রানীরা জরুরী বৈঠকে বসেছে। কি করা যায়, কি করা যায়। কিন্তু বিকাল ফুরিয়ে গেলো। কেউ কোন বুদ্ধি দিতে পারল না, সিদ্ধান্ত তাই হলো না। যে যার বাড়ি ফিরে গেলো। নিজের জীবনই সবচেয়ে প্রিয়, কে যেচে জানটা হারায়।
একটা ফড়িং সেই সময় সেই বনের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। সে দেখলো, সবাই কেমন মলিন মুখে এক সাথে মিটিং ভেঙ্গে দিয়ে সরে যাচ্ছে। ব্যাপার কি, এই ভেবে সে সোজা নেমে এলো পিপীলিকার রাণীর কাছে।
কি হয়েছে? কি হয়েছে?
রাণী ধমকের সুরে বলল, যেখানে যাচ্ছ যাও, এই সব জেনে তোমার কাজ নেই।
ফড়িং চঞ্চল গলায় বলল, আমাকে বল না, কেন তোমরা সব প্রানী মলিন মুখে ফিরে যাচ্ছ?
পিপিলিকার রাণী বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না কারো চিৎকার, কারো কান্নার সুর?
হ্যা পাচ্ছি, আমি উত্তরটা পেলে সেই কথাও তমার কাছে জানতে চাইতাম, কে কাদে এভাবে?
পিপলিকার রানী বিরক্ত গলায় বলল, তুমি কেন বিরক্ত করছো।
আহা বলই না। ফড়িং আবদারের সূরে জানতে চাইলো।
এই বনে একজন ভয়ংকর ভূত বাস করে তার বাচ্চা সহ। সে রেগে গেলে কারনে অকারনে যাকে কাছে পায় তারই ঘাড় ভেঙ্গে দেয়। তার বাচ্চাটাই কাদছে। এখন যদি ভূত এসে বাচ্চাকে কাঁদতে দেখে, তখন যদি সে মনে করে এই বনের প্রানীদের কারনে তার বাচ্চাটা কাঁদছে তখন কি হবে? সে তো সবাইকেই মেরে ফেলতে পারে। আবার কেউ সেই বাচ্চাটার কাছে যেতেও ভয় পাচ্ছে। যখন যাবে তখনই যদি ভূতটা এসে পরে। তখন তার জানটাও তো যাবে। তাই না?
ফড়িং হতাশ গলায় বলল, এ তো দেখি বিরাট বিপদে পরেছো তোমরা। হ
মোঃ নোমান সরকার
বড় মামা বলল, তুমি যদি ওয়াশরুমের কমোডের কভারটা নামিয়ে না রাখো, তাহলে কমোডের ভিতরের সব ব্যাকটেরিয়াগুলো উঠে আসবে। আর সারা ওয়াশরুমে ছোটাছুটি করবে। ওরা তোমার দাঁতের ব্রাশে এসে শুয়ে থাকবে। এয়্যা! কি বিছরি ব্যাপার। আর সেই ব্রাশ দিয়ে তুমি দাঁত মাজলে…..।” বলেই থামল বড় মামা।
এই কথায় ইরার কান্না পেয়ে গেল। সত্যি সত্যিই দুষ্ট ব্যাকটেরিয়াগুলো ওয়াশরুমে বাস করে? সাইন্স টিচার সেরকম কথা বলেছিলেন একদিন। কিন্তু তখন কেন তিনি বলেননি, কমোড ফ্লাস করেই কমোডের ঢাকনা নামিয়ে রাখতেই হবে। ছিঃ ছিঃ ব্যাকটেরিয়াগুলো এতই দুষ্ট…। আর সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো ব্রাশে এসে শুয়ে পরবে। আর সেই ব্রাশ দিয়ে দাঁত……। ইরার চোখে পানি এসে গেল।
বড় মামা এসেছেন কানাডা থেকে। ছোট মামার বাসায় আছেন তিনি। সেখান থেকে আজ সকালে ইরাদের বাসায় এসেছেন। সেই নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে ইরার মা বাবা ঘরের অনেক কিছু বদলে ফেলার কথা ঠিক করেছিল। যার কিছু কিছু ইরা শুনতে পেয়েছিল। এইসব নিয়ে তার আনন্দের সীমা ছিল না। গত রাতে মা আর বাবা বাসা সাজ্জাচ্ছিল। আর সকাল থেকে মা রান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। বাবা একটু পর বাইরের থেকে কি যেন আনেন। মামা এসে তো মহা বিরক্ত, দুইজনের একজনকেও পাচ্ছেন না। ইরা ছোট মানুষ। তার সাথে মামা কি আর কথা বলবে। আর সে কেন যেন বড় মামাকে দেখে ভয়ে সিটকে আছে। ইরা নিজেকেই বুঝতে পারছে না। বড় মামার গল্প এত শুনছে, ছবি দেখেছে, ভিডিওতে দেখেছে। তবুও ইরা মামার সাথে সহজ হতেই পারছে না। মামা পুতুল, খেলনা, চকলেট সহ কত কি দিয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তার ভয়ই কাটছে না।
বড় মামা বলল, ইরা তুমি কি তোমার ওয়াশরুমের কমোডের কভারটা নামিয়ে রেখে আসবে? আমি দেখেছি, সেটা খোলা আছে। নাকি আমি এই কাজে তোমাকে সাহায্য করব। বলেই বড় মামা উঠে দাঁড়াল। দাঁড়ালে মামাকে অদ্ভূত সুন্দর দেখায়। ছোট মামার ইয়া বড় ভুঁড়ি। আর বাবাও। কিন্তু বড় মামা এত বড়, অথচ উনার কোন ভূড়ি নেই। সিনেমার নায়কদের মতন। ইরার খুব ভাল লাগল।
বড় মামা হাত বাড়িয়ে বলল, এই যে পিন্স তুমি কি তোমার হাতটা দিবে?
ইরা বিস্মিত হল ঠিকই তবুও হাত এগিয়ে দিল। বড় মামা ইরার ছোট্ট হাত হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো।
ওয়াশরুমের কমোডের ঢাকনা খোলা। বড় মামা বলল, “ইরা কমোডের ঢাকনাটা বন্ধ করে এসো। প্রয়োজন ছাড়া এটা খুলবে না, ঠিক আছ? কমোডের ভিতরে অগনিত ব্যাকটেরিয়া বসবাস। খোলা পেলেই ওরা খেলতে নামবে। আর ওরা তোমার ব্রাশও দখলে নিবে।”
”হ্যা, মামা আমার মনে থাকবে। ঐ দুষ্টদের আমি কখনো সুযোগ দিব না।” বলতে বলতে ইরা নিজেই অবাক হল, বড় মামার সাথে সে সুন্দর করে কথা বলতে পারছে বলে।
বড় মামার হাত ধরে ইরা ফিরে এলো ড্রইং রুমে। তার এমন হল যে মনে হচ্ছে বড় মামা এ বাড়িতে থাকে। আর সে সব সময় গল্প করে, খুবই ভাব।
“বড় মামা আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
বড় মামা আনন্দিত গলায় বলল, “হাজার বার প্রশ্ন করতে পারো।”
ইরা বলল, “আমার আরবী টিচার যে আমাদের ওয়াশরুমে প্রবেশের আগে একটা দোয়া পড়া শিখিয়েছেন, সেটা কি এই ব্যাকটেরিয়াদের জন্য। এরা কি জিন?”
বড় মামা বলল, “না বাবা, এরা জিন না। এরা অতি ক্ষদ্র এক প্রানী। এ নিয়ে আমি তোমাকে অনেক অনেক গল্প বলব। এদের সমন্ধ আমাদের অনেক বেশী জানার আছে।”
ইর বলল,”টিচার বলেছেন, “ওয়াশরুমে কিছু দুষ্ট জিন থাকে, ওদের জন্য এ দোয়া পড়তে হয়।”
বড় মামা বলল, “ব্যাকটেরিয়াদের যেমন আমরা দেখতে পাই না, তেমনি ওয়াস রুমের দুষ্ট জিনদেরকে আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু ওরা ঠিকই আমাদের দেখতে পায়, যেমন ব্যাকটেরিয়াগুলো আমাদের দেখতে পায়। আমরা কমোডের ঢাকনা বন্ধ করে দিলে ওদের আর কিছুই করার থাকে না, আটকে ফেলি ওদের। তাই না? তেমনি দোয়াটা পরলেই আমরাও জিনদের কাছে অদৃশ্য হয়ে যাই। দোয়া পড়লে দুষ্ট জিনরাও আমাদের খুঁজে পায় না। আর তুমি বৃষ্টির দিনের কথা ভাবো তো। একটা ছাতা আমাদের কত বড় বন্ধু। তাই না? বৃষ্টির দিনে ছোট্ট একটা ছাতা যেমন করে আমাদের বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচায় ঠিক তেমনি এই দোয়াটা দুষ্ট জিন থেকে আমাদের বাঁচায়। এই দোয়াটাও আমাদের বন্ধুর মতন। এসো আমরা ওয়াস রুমের ব্যাকটেরিয়ারদের বিষয় ভালো করে জানি। জীবনের প্রয়োজনেই এই বিষয়গুলো জেনে রাখতে হবে।”
ইরা মাথা ঝুকালো। যেন সে কথা খুব বুঝেছে।
বড় মামা ঘরের ছাদের দিকে তাকালো। ইরা ও।
এবার বড় মামা ইরার দিকে তাকিয়ে বলল, “ফ্লাস করার সময় ব্যাকটেরিয়া কমোড থেকে বেশ উপরে উঠে আসে। উঠে আসতে পারলেই ওরা ছরিয়ে পরে ওয়াস রুমে। তাই ফ্লাস করার সময় কভার বন্ধ করে নিতেই হবে। বলে বড় মামা থামাল। থেমে জোর গলায় বলল, যেন ইরা শুনতেই পায়নি। “কভার ফেলেই ফ্লাস করতেই হবে, মনে থাকবে ইরা।”
ইরা লাফিয়ে উঠে বলল, “হ্যা মামা মনে থাকবে। ওদের দুষ্টুমি করতে দেওয়া যাবেই না।”
তখনই পিছন থেকে বাবা এসে বলল, “কিরে ইরা, মামার সাথে অনেক গল্প হচ্ছে। আয়, আমরা বারেন্দায় গিয়ে বসি। মিষ্টি রোদ আছে সেখানে।”
মোঃ নোমান সরকার
নিতুকে বললাম, ‘চুলা জ্বালানো যাবে?’
নিতু বলল, ‘না। এখন না।’
আমি বললাম, ‘পানি গরম করতে হবে। আর তেজপাতা কোথায় রেখেছ, বলত?
‘ নিতু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘পানি গরম করতে হবে মানে? এত ঠান্ডা তো পরেনি। নরমাল পানিতেই গোসল করো। আর তেজপাতা দিয়ে কি হবে?’
‘তেজপাতা পানিতে ডুবিয়ে সেই পানি গরম করে গোসল করব?’ আমি কথাটা বলতে বলতে মুগ্ধ চোখে নিতুকে দেখলাম। সে নীল রং এর একটা শাড়ি পরেছে। নিতু আজকাল সহজে শাড়ি পরে না। ওকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আমি চোখ সরালাম না।
নিতু অবাক হয়ে বলল, ‘তোমার মাথা টাথা ঠিক আছে তো।’
আমি হাসলাম, ‘গায়ে ঘামের বাজে গন্ধ, সারাদিন আজ রোদেই কেটেছে। আর তেজপাতার পানিতে মরা চামড়া উঠে যায় সহজে। ত্বক নরম হয়। সতেজ লাগে। নেটে সার্চ দিয়ে দেখতে পার। কেবল রান্নায় না শতশত বছর ধরেই গসলের পানিতে এর ব্যবহার হচ্ছে।’
নিতু রেগে গিয়ে বলল, ‘এত সাজগোছ! বিষয় কি! আরেকটা বিয়ে করার মতলব হয়েছে। তাই না? বিয়ের বিষ নামানোর মন্ত্র আমার কাছে আছে।’
আমি কিছুক্ষন হাসলাম, ‘তেজপাতা কোথায় রেখেছ?’
নিতু তেড়ে এলো, ‘একটু আগে আমি রান্না ঘর পরিস্কার করেছি। তুমি আমার রান্না ঘর নোংরা করবে না,প্লিজ। আমার সবকিছু জায়গা মত রাখা। সংসার শুরু করার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন একটা জিনিশ এদিক সেদিক হয়নি। আর তুমি রান্না ঘরে ঢুকা মানেই সব এলোমেলো। আমি কিছুতেই দিব না। তুমি সরো।’
আমি বুঝে গেছি আজ আর হবে না তেজপাতা পাওয়া। আরেকটা কাজ করা যায়। কিছুক্ষন অপেক্ষা করা যায়। নিতু রাতে সব কাজ সেরে কম্পিউটারে অন লাইনে খবরের কাগজ পড়ে। খরচ বাঁচাতে দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করেছে নিতু গত মাস থেকে। আমি বাসা থেকে সকালে বের হই, তাই এই নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। দৈনিক পত্রিকা অফিসেই পড়া হয়। কিন্তু নিতু তো পড়ে। মনটা এই নিয়ে খারাপ ছিল। যদিও এ নিয়ে কথা হয়নি। বলতে ইচ্ছেও করছিল না। কাগজে পাতা আর কম্পিউটারের পড়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। সকালের খবরের কাগজের ঘ্রাণ একেবারেই তো আলাদা।
আমি ঠিক করলাম নিতু কম্পিউটারে কাছে বসলেই সেই ফাঁকে রান্না ঘর হানা দেওয়া যাবে। আমি রান্না ঘর থেকে শোবার ঘরে ঢুকতেই নিতুও ঢুকল।
আমি নীচু গলায় বললাম, দেরি করে ফেললাম। মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। ধ্যাত!
নিতু বলল, ‘বাবা! বাবা! করতে করতে ঘুমালো।’
আমি বললাম, আহ! মেয়েটা আমার ঘুমিয়ে গেছে। হুম। তোমার সাথে ছাড়া গল্প করার কেউ নেই। এসো গল্প করি। গল্পের শুরুতে তোমাকে ছুঁয়ে দেই।’
না। এই ময়লা হাতে তুমি আমাকে ছুবে না। যাও, আগে গোসল সেরে নাও।’
আমি বললাম, ‘হুম। আচ্ছা ঠান্ডা পরেছে না খুব?’
নিতু সাদামাটা গলায় বলল,’স্যারের এখন চা লাগবে। তাই না? ওসব হবে না। এখন থেকে ২কাপ চা। নাস্তার পরে আর সন্ধ্যার পর তুমি এলে। আগামী বছর থেকে ইলা যাচ্ছে স্কুলে। বাজে অভ্যাস সব ছাড়তে হবে। একটা নিয়মের ভিতর আসতেই হবে।’
আমি খানিক ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘সব নিয়ম কি আজ থেকে পালন করতে হবে?’
নিতু বলল, ‘গসল সেরে আসো। তারপর নিয়মগুলো নিয়ে আলোচনা করি। আর আজ থেকে শুরু করলে কেমন হয়? চা দিয়ে শুরুটা করা যাক।’
আমি বিরক্ত গলায় বললাম,’খুবই বাজে চিন্তা ভাবনা তোমার। আচ্ছা চায়ের দরকার নেই। একটু পানি গরম করি, কফি খাই।’
নিতু অবাক গলায় বলল,’কফি ফুরিয়েছে দেড় মাস আগে।’
আমিও অবাক হলাম,’বলনি তো!”
নিতু বলল,’বাজারের লিস্টে লেখা আছে। আমি বাজারের লিস্ট তোমাকে মেইল করেছি তাও ৩ দিন আগে।’
আমি পকেট থেকে দ্রুত মোবাইল ফোনটা বের করে মেইল চেক করলাম। বাজারের লিস্ট দেখে আঁতকে উঠলাম, ‘আরে চা পাতাও নেই!’
নিতু গলা নামিয়ে বলল,’তুমি চা খেতে চেয়েছ। আমি দেইনি এমনটা কি হয়েছে? আমি বলতে গিয়েও বলিনি। ভাবলাম যখন লিস্ট দেখবে সেটা তো দেখবেই।’
আমার খুব খারাপ লাগল। তার মানে সকালে আমি আজ চলে গেছি তাড়াহুড়া করে নাস্তা না খেয়ে, দেরি হয়েছিল বলে। তাহলে সকালের চা নিতু খেতে পারেনি।
নিতু পরিবেশটা হাল্কা করতে একটু অভিনয় করে বলল, ‘স্যারের আজকাল শরীরের ঘ্রাণ আর মরা চামড়া নিয়ে ভাবা হয়। কিভাবে ঘরের খবর রাখবে? সুখে আছো বাবু।’
আমি ভারী লজ্জা পেলাম। বারেন্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারেন্দার গ্রীল্টাকে খামচে ধরে রাতের আকাশের দিকে তাকালাম। রাতের আকাশটা মেঘে ঢেকে আছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়েই রইলাম। আচ্ছা,আকাশটা কত বড়। আকাশ এত বড় কেন? আর আমাদের মাটির পৃথিবীটা এত ছোট কেন? এই প্রশ্নের ভিতর আমি ডুবে গেলাম।
নিতু এসে পাশে দাঁড়াল। একটা হাত রাখল আমার কাধে। আমি খুব নীচু গলায় বললাম, আকাশটা এত বড়! আর পৃথিবীটা কত ছোট! ছোট পৃথিবী!
মোঃ নোমান সরকার
মুসা খুবই বিরক্ত হয়ে বাসে উঠল। বৃষ্টিতে তার সার্ট প্যান্ট, জুতার অনেক খানি ভিজে গিয়েছে। আজ চাকরি ইন্টারভিটটা দিতে আসতেই ইচ্ছে করছিল না। খামখা আসা। চাকরির সাথে ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নের কোন মিল নেই।
আজ বৃষ্টি আর জোরাল বাতাসের মাখামাখি। আজকের দিন ছিল কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকার দিন। মুড়ি, চানাচুর পিয়াজ ,ভাজা রসূন আর সরিষার তেল দিয়ে মাখিয়ে খাবার দিন। মেসে অবস্থা মুসার জানাই আছে। সারিষার তেল নেই, চানাচুর নেই, পিয়াজ ফুরিয়েছে,রসূন আছে সম্ভবত। মেস মেম্বার বলতে গতকাল থেকে সে একা। মোট তিন জন মিলে ছিল তারা মেসে অনেক দিন ধরে। হঠাৎ করেই দুইদিন আগে তারা একযোগে মেস ছেড়েছে। এ নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়েছে নিজেদের ভিতর। তিনজনের চমৎকার সম্পর্কটা কয়েক ঘণ্টায় বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিল। মানুষের সম্পর্কটা মানুষের চেয়েও আর বেশি অদ্ভুত আর জটিল। অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমনটা কখনো তার জীবনে ঘটেনি। মানুষ আসলেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শিখে। গল্প উপন্যাসে কত কথা এমন পড়েছে। অথচ এই অনুভূতি একেবারেই ভিন্ন। যেন নতুন ভাবে নিজেকে অবিস্কার করতে পেরেছে।
বাসে ৮/৯ জন পেসেঞ্জার। মুসা বাসের জানালার পাশে বসে আছে। বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টিতে বাস জায়গায় জায়গায় দাঁড়াচ্ছে অনেক সময় নিয়ে যাত্রী নিবার জন্য। এ নিয়ে সামনে বসা যুবকের সাথে বাস কণ্টেকটারের বার বার কথা কাটাকাটি হচ্ছে। মুসার এই সব ভাল লাগছে না। কিছুই ভাল লাগছে না। সে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। অথচ মনে হচ্ছে কিছুই দেখছে না।
বাস কন্টেকটারের চিৎকারে সে যেন অন্য কোথাও থেকে ফিরে এলো। বাস কণ্টেকটার তার সামনে বসা বয়স্ক লোকটাকে রীতিমত ধমকাচ্ছে। আজকাল মানুষের যে কি হয়েছে বয়স্ক মানুষের সাথে অনেক মন্দ আচরণ করে। তার বাবার বয়সী একজন মানুষের সাথে কি বেয়াদবি আচরণ করছে। মুসা বিরক্ত হয়ে বাস কণ্টাকটারের দিকে তাকল। তারপর বয়স্ক মানুষটির দিকে। লোকটার চাহনি, চুল কাঁটা , সার্ট দেখে রুচীরশীল মানুষ মনে হচ্ছে। আভিজাতের একটা ছাপ আছে চেহারায়। সেই বয়স্ক লোকটি বাস কন্টেকটার রীতিমত ধমকের সাথে কথা বলছে!
বাসের কণ্টেকটার বলছে , ভাড়া ১০ টাকাই। ৫ টাকা ভাড়া আমি নিব না, আপনাকে এই পর্যন্ত দশবার বলে গেছি। আরে বুঝেন না ক্যান আপনি আগে নামলে সমস্যা ছিল না। এখন কাউন্ট হয়ে গেছে, লেইখা দিচ্ছে কয়জন।
মানুষটা শান্ত ভাবে বলল,’আমার কাছে আর নেই। ৫টাকাওই আছে, এটাই নিতে হবে।’
‘৫ টাকা ভাড়া অনেক আগে ছিল। অনেক দিন হইছে ভাড়া বাড়ছে। ৫টাকা দিলে হইব না। আচ্ছা ঠিক আছে আপনি পরের ইষ্টেশনে আপনাকে নেমে যেতে হইব। বানানীর ভাড়া ১০টাকাই। এক টাকাও কম নিব না।
আমি নামব না। আমার কাছে তো ৫টাকাই আছে। তুমি বললেই হল, সামনের ইষ্টেশনে নেমে যেতে হবে। আমি নামব না। তোমাকে ৫টাকা দিলে, নেমে আমি কি হেঁটে যাব বানানী? আর তুমি বললে, ভাড়া তো ৫টাকা ছিল। যখন খুশি বাড়াবে। মানুষের যে কষ্ট হয় এ নিয়ে কি তোমরা ভাব।’
কন্টেক্টার অধরয্যের গলায় বলল,’আমি তার কি জানি। আপনি এই সব মালিককে কন। আমরা চাকরী করি। আর আপনাকে নেমে যেতেই হবে। আর না হলে ১০টাকা দিতেই হবে।’
‘আমি নামব না। ৫ টাকাই আছে আমার কাছে।’
‘নামতেই হবে। তা না হলে ১০টাকা দিতে হবে।’
বয়স্ক লোকটা খুব শান্ত গলায় বলল, ‘১০টাকা ভাড়া তো বেশি নিচ্ছ।’
বেশি নিব কেন? অন্য পেসেঞ্জারদের জিগান? এই যে নম্বর আছে ফোন করেন।
হ্যা আমি ফোন দিব। আচ্ছা বললাম তো আমি ফোন দিব। ৫ টাকার ভাড়া ১০ টাকা বলছ। যখন তখন ভাড়া বারাবে। বললাম ১০টাকা নাই ৫ টাকা আছে। ‘ বলে মোবাইল বের করল। মুসাও ভাবল উনি ফোন করবে। তিনি তা করলেন না। তিনি মবাইলে অন লাইনে গিয়ে ইংরেজীতে লেখা কিছু একটা পড়তে লাগলেন। মুসা চোখ সরিয়ে বাইরের দিকে তাকাল।
কন্টেক্টার সামনের দিকে গেল। মুসা আবার বয়স্ক লোকটার দিকে তাকাল, তিনি মনযোগ দিয়ে ইংরেজীতে লেখা আর্টিকেল বা এমন কিছু একটা পড়ছেন। মুসা বাইরের দিকে তাকাল। খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরে একটা ডিম আছে। একটাই আছে। ডিম দিয়ে ভাত খেতে ভাল লাগবে। মুসা আবার ভাবনার জগতে চলে গেল।
কন্টেকটারের চিৎকারে আবার সে ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলো।
‘আপনি এখানে নামেন।’
মুসা দেখল বাসটা থেমেছে।
‘আমি তো বলেছি আমি নামব না। আর বৃষ্টির মধ্যে আমি নামবই না।’
‘আরে আপনারে এই খানেই নামতে হইব। ১০ টাকা না দিলে আমি আপনারে যাইতে দিমু না। আছে আপনার কাছে টাকা। আর ফোন দিছিলেন?’
বয়স্ক মানুষটা কিছু বলল না।
‘আমি আগেই বুঝছি ফোন দিবেন না। বয়স হইছে, মিছা কথা বলইলেন না। ৫টাকার জন্য আপনি এমন করতাছে কেন, এমনিতেই পেসেঞ্জার নাই। আমার চাকরি থাকব না। গুওইনা গেছে ৯ জন পেসেঞ্জার।’
ড্রাইভার বলল, ‘বাবারে কেন খমকা ঝামেলা করতাছেন। গুনে গেছে ৯ জন। টাকা আপনাকে দিতেই হবে বাবা। দিয়া দেন তো।’
মুসা বুঝল ড্রাইভার কথা বলায় কন্টেকটার আরও বেয়াদবি করবে, মুসা ইশারা করল কন্টেকটারকে। হাত দিয়ে ইশারায় বুঝাল, বয়স্ক লোকটার থেকে টাকা নিবার দরকার নাই, আমি দিচ্ছি।
ইশারা করায় কণ্টেকটার যেন খেপে গেল। সে কিছুটা এগিয়ে এসে বলল, ‘আরে ভাই আপনি দিবেন কেন? আপনি কি উনার আত্মীয়? আর এতখন কৈ ছিলেন। এইখন ধইরা যে বকবক করলাম তখনই কইতেন টাকাটা আপনি দিবেন।’
মুসা বিরক্ত গলায় বলল,’ ভুল হতেই পারে। ম্যনিব্যাগে টাকা উঠাতে আমারই প্রতিদিন ভুল হয়। ৫০০টাকার জায়গা ১০০টাকা নিয়ে বের হই। এমন বিপদ আমারও অনেকবার হয়েছে। নাও ১০টাকা।’
বয়স্ক লোকটা বলল, ‘আরে আপনি কেন টাকা দিবেন? ৫টাকাই ভাড়া। ৫ টাকাই নিবে।’
কন্টেকটার আবার চিৎকার করে উঠে।
মুসা বলল, ‘টাকা পকেটে বা ম্যানিব্যগে নিতে ভুলে গেছেন হয়ত। সমস্যা নাই। আমার একবার এমন হয়েছে। আমার বাসের টাকা আরেকজন দিয়েছিল। আমি আজ আপনারটা দিলাম। আরেকদিন আপনি কার দিবেন। হয়ে গেল।’
কণ্টেকটার ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে গেল। বয়স্ক লোকটা উঠে মুসার পাশে এসে বসে বলল, ‘আমি বনানী যাব। আপনি? ‘
মুসা বলল, ‘আমিও বানানী যাব। একজনের সাথে দেখা করতে হবে।’
বয়স্ক লোকটা বলল, ‘আজকাল কেউ কার বিপদে এগিয়ে আসে না।’
মুসা বলল, ‘আমি এভাবে দেখি না। আমার মনে হয়, এগিয়ে আসার মানুষই বেশি।’
বয়স্ক মানুষটা বলল, ‘আমার বয়স হয়েছে। অভিজ্ঞতাও বেশি। আমি অনেক বেশি দেখেছি, আর অনেক বেশি দেখতেও পাই।’
মুসা বলল, জীবন হচ্ছে তাই, ‘যেভাবে আমরা দেখি, যেভাবে আমরা ভাবি, বুঝি। জীবন এর বাইরে না। দেখবার উপরই সবকিছু নির্ভর করে।’
বয়স্ক লোকটা অবাক গলায় বলল, ‘বাবা তোমার কথা আমাকে অভিভুত করল। কিছু মনে কর না, আমি তোমাকে তুমি বললাম।’
মুসা হেসে বলল, ‘আমি আপনার ছেলের বয়সী।’
বয়স্ক লোকটা বলল, ‘তোমার কথা ভালো লেগেছে। তা তুমি কোথায় থাক।’
মুসা বলল, ‘উত্তরখানে, উত্তরার পিছন দিকটায়।’
বয়স্ক লোকটা বলল, ‘হ্যা আমি চিনি। আরে আমরা অনেকখন ধরেই কথা বলছি। তা তোমার নাম কি?’
‘আমার নাম মুসা।’
‘আরে আমার নামও মুসা। মুসা বিন শমসের।’
‘নামটা খুব চেনা চেনা লাগছে।’
‘আরে হ্যা চেনা চেনা লাগবে না। এই নামে যে বাংলাদেশের সেরা ধনী একজন আছে। ভালোই লাগে নিজের নামের জন্য।’
মুসা হাসল। মুসা বিন শমসের। হ্যা মনে পড়েছে। তার নামেও নাম।
এর মধ্যে বনানী চলে এসেছে গাড়ি। বৃষ্টি থেমে গেছে। দুইজনই বাস থেকে নামবে। মুসা আগে নামল। আর মুসা বিন শমসের পরে। মুসা জানল না কি ঘটে গেল। সে উল্টো দিকে তাকাচ্ছে রাস্তা পার হতে হবে। মুসা বিন শমসের বাস থেকে নামার সময় কণ্টেকটারের হাতে চার ভাজ করা এক হাজার টাকার নোট দ্রুত গুজে দিয়ে নীচু গলায় বললেন, ফাজিল, বিপদে পরা বয়স্ক মানুষের সাথে এমন আচরণ করে? ৫ টাকার বেশি ভাড়া না দিয়া বনানী নেমে দেখতাম তুই কি করিস। আছার দিয়া তরে……।’ এই টুকু বলে তিনি নামলেন। নেমেই তিনি কণ্টেকটারের দিকে তাকালেন। কন্টেকটার হ্যা করে তাকিয়ে আছে হাতের নোটটার দিকে। কণ্টেক্টারের বিশ্বাসই হচ্ছে না কেউ তাকে এক হাজার টাকার নোট বকশিশ হিসাবে দিতে পারে, তাও তার খারাপ ব্যবহারের কারনে! তার সারা জীবনে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটতে দেখেনি।
মুসা বিন শমসের ডাকল মুসাকে। চল আগে রাস্তা পার হই। বলে দুইজনে রাস্তা পার হল। তারপর তিনি বললেন,’ তুমি আমার থেকে ১০টাকা পাও। সেটা এবার দিবার সুযোগ হয়েছে। চল আমি যে অফিসে কাজ করি। খুবই সাধারণ চাকরি। চল, এক কাপ চা ত খাওয়াতে পারব তোমাকে।’
মুসা বলল, না না এটা আর দিতে হবে না। আপনি বিপদে পরেছেন। এটা তো যে কার দায়িত্বের মধ্যেও পরে। আমি কাছে ছিলাম। আমি আসি। দেখা হবে আবার।’
আরে না না বলছ কেন? তুমি তো দিয়েছ। আমি ঋণে থাকবই বা কেন? তোমার তাড়া নেই তো? আরে আমার লাগবে ১০ মিনিট। প্লিজ।’
বয়স্ক মানুষ প্লিজ বলছে মুসা বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আমার তাড়া নেই। একজনের সাথে কেবল দেখা করা।’
মোঃ নোমান সরকার
খুব বিরক্ত হয়ে ঘাড় বাকিয়ে ছোট কোকিলটা বড় গাছের নিচে নাপিতের লাগানো নতুন দোকানটা দেখলো। সকাল থেকে বসে আছে সে গাছের ডালে। খাবার খুঁজতে বের হয়নি। সকালে এক নাপিত ঠুক ঠুক করে গাছে পেরেক মেরে যখন বড় একটা আয়না ঝুলালো, তা দেখে খুব মন খারাপ হলো তার। গাছের প্রতি মায়া নেই, এ কেমন মানুষ!
মানুষদের অত্যাচারে প্রতিদিন পাখিরা এই গ্রাম ছাড়ছে। গ্রাম থেকে প্রতিদিনই গাছ আর পাখি, দুইটি অদৃশ্য হচ্ছে। কেউ না কেউ গাছ কাটছে । আর সেই সব গাছের পাখিরা শোকে শোকে গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে। পাখিরা একটা মানুষও পেল না যে রুখে দাঁড়ায়, বাঁধা দেয় গাছ কাটায়! গাছ মানুষেরও বন্ধু, সে কথা মানুষ একেবারেই ভুলে গেছে। এই কথা প্রতিদিন আলোচনা হয় পাখিদের ভিতর। কিন্তু কিভাবে সেই সব কথা জানাবে মানুষকে!
পাশের গাছটা গত সপ্তাহে কাটা হয়েছে । কবে কখন এই গাছ কেটে ফেলে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল এই গাছের পাখিরা ! সেই থেকে এক এক করে এই গাছের পাখিরাও চলে গেছে । শুধু ছোট কোকিল যায়নি। বয়সে সে অনেক ছোট ,অনেক বেশি উড়তে হলে কষ্ট হবে। তাই তার মা বলে গেছে , ‘তুমি তো ছোট ,তাই নতুন বাসা খুঁজে বের করার মতন কষ্ট করার তোমার প্রয়োজন নেই। আবার , বয়স এতটাও কম না যে ,আমার সাহায্য তোমার দরকার হবে। তাই তুমি এখানেই থাকো। খুব বেশি একটা দূরে যেও না। কাছাকাছি এলাকা থেকে খাবার সংগ্রহ করো। ভালো আর সুবিধা মতন বাসা পেলে তোমাকে নিয়ে যাব। নিজের দিকে খেয়াল রেখো আর যত্ন করো।’
সেই থেকে ছোট কোকিলটা একা থাকে এই গাছে।
সকাল থেকে সে দেখতে লাগল নাপিতের দোকান সাজানো । লোকজনের আনাগোনা । মন তার খুব খারাপ হয়েছে। তবে গাছ কেটে ফেলার চেয়ে এটা ভালো। এসব ভেবে ভেবে আর এসব শব্দ করে করে নিজেকে এটা সেটা বলে শুনিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই সকাল পেরিয়ে দুপুর হলো। লোকজন একেবারেই কমে গেল। কোকিলটা এক সময় দেখল আশেপাশে নাপিত ছাড়া আর কেউ নেই। এর একটু পরে নাপিতও দোকানের পাশে ঘুমিয়ে গেল। অনেক ভেবে কোকিলটা নিচে নেমে এলো , নাপিতের দোকানে। দোকানের কাছে আসতেই কোকিলের চোখে পড়ল আয়নায়। নিজেকে আয়নায় দেখে ঘাবড়ে গেল ! ভাবল অন্য কোন কোকিল ! আরে এই কোকিলটা , এখানে কখন এলো ! তারপর একটু পরেই বুঝল , এটা সে নিজেই ! কোকিলটা আরেক বার ঘুমন্ত নাপিতকে দেখল। তারপর চারপাশ দেখে আয়নার কাছাকাছি উড়ে এসে বসলো। তারপর নিজেকে দেখ্লো। দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল! আমি এত সুন্দর! এত সুন্দর! আরে কি আশ্চর্য ব্যাপার , আমি এতই সুন্দর !
সেই দিন থেকে ছোট কোকিল রোজ কয়েকবার উড়ে যায় আয়নার কাছ দিয়ে। আর চারপাশে কেউ না থাকলে উড়ে এসে বসে। নিজেকে দেখে। গর্বিত চাহনিতে নিজেকে দেখতেই থাকে। যেন নেশা কাটেনা এমনি ভাবে।
এভাবেই চলল বেশ কয়েকদিন । একদিন কোকিল নিচের এক ডালে বসে আছে। তখন একটা কাক এসে গাছের ডালে বসল। কাককে দেখতেই কোকিল কিছুটা রেগে বলে উঠল ,’একটু দূরে গিয়ে বসো, কি বিচ্ছিরি দেখতে !’
এ কথায় কাকের মন খারাপ হলো। তবে বেশি একটা না। কারন এমন কথা সে আগেও অনেক বার শুনেছে। তার জন্য এটা নতুন কিছু না । কাকটা বিরক্ত হয়ে বলল , ‘ তা ভাই ,তুমি নিজেকে নিশ্চয় অনেক সুন্দর ভাবছ ? বড় কিছু ভেবে নিচ্ছ?’
কোকিল বিস্ময়ের সাথে বলে উঠল , ‘ তুমি কি আমাকে বলছ ! আমাকে ? আমাকে বলছ কি ?’
কাক এদিক সেদিক তাকিয়ে কোকিলের দিকে তাকাল এবার । তারপর চাবিয়ে চাবিয়ে , ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলল,‘এখানে সম্ভবত আর কেউ তো নেই !’
কোকিলের ভীষণ মন খারাপ হল । মন খারাপ গলায় বলল, ‘ব্যাঙ্গ ছলে বললে বলে মনে হলো !’
কাক এবার শান্ত গলায় বলল,‘তোমার কি মনে হয় , আমি মিথ্যে কিছু কি বলেছি? ‘
কোকিল উত্তেজিত গলায় বলল,‘তোমার চোখে কোন অসুখ নেই তো।’
কাক নিরশ গলায় বলল,‘নাতো!’
কোকিল অবাক আর নীচু গলায় বলল,‘তবে তো তুমি আমাকে ভা্লো করে দেখনি ! ‘
‘ হতে পারে আমি তোমাকে ভালো করে দেখিনি । ঠিক আছে ,আমি তোমাকে দেখে নেই তবে। ‘
কোকিল বলল , ‘আমাদের এই এলাকায় যত পাখি ছিল ,আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর! যদিও ইদানিং আমি আমার মা কে ছাড়া চড়ুইদের আর অল্প কিছু পাখি ছাড়া কাউকে দেখিনি। তারপরও আমি নিশ্চিত , আমি দেখতে কল্পনাতীত সুন্দর!’
কাক কোকিলের কথায় অনেক বিরক্ত হলো। তারপরও অনেকখন কাক কোকিলকে দেখতে লাগল।
কাকের কথায় কোকিলের মন অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অসুন্দর কাক কি অদ্ভুত কথা বলে ! সে নাকি সুন্দর না! এবার নিশ্চয় ভালো করে দেখে , ঠিক করে বলবে ! কি অদ্ভুত সুন্দর আমি ! কি অপূর্ব সুন্দর চোখ ! কি অপূর্ব সুন্দর ঠোট ! কি অদ্ভুত সুন্দর তার ডানা ,আর ডানা মেলে ধরা ! নিজেকে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে অজস্রবার।
কাক কয়েক পা কোকিলের সামনে এগিয়ে এলো। কাক আনন্দহীন গলায় বলল , আমি তো বলিনি , তুমি অসুন্দর। কিন্তু তুমি ততো সুন্দর নও। তোমার চেয়ে ঢের সুন্দর পাখিদের আমি দেখি প্রতিদিন। সে কথা যাক, তুমি ছোট একটা পাখি , সুন্দর নিয়ে তুমি এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন ! এতো একটা ফালতু বিষয়! তোমার আচরণ কেমন সুন্দর, সেটাই তো বড় বিষয়।’
কোকিল অস্থির গলায় বলল,‘ কাক তুমি আমাকে খেপাচ্ছ ‘?
কাক অবাক হয়ে বলল,‘কেন কেন, তোমাকে খেপাতে যাব কেন?’
কোকিল রাগ আর অভিমান মিশানো স্বরে বলল ,‘বাহরে ,তুমি যে ভুল বকে যাচ্ছ !’
‘আমি ! আমি ভুল বলে যাচ্ছি মানে কি! আর ভুল বা কি বললাম!
কোকিল ভারী গলায় বলল,‘তুমি আমাকে অপমান করছো! আর আমি তোমাকে শুরুতে বলেছিলাম, একটু দূরে গিয়ে বসো , কি বিচ্ছিরি দেখতে! এটা বলাতে তুমি যা ইচ্ছে তাই বলছ আমাকে?’
কাক গম্ভীর গলায় বলল ,‘ না তো। তবে শব্দ উচ্চারণে সতর্ক থাকা ভালো। বিচ্ছিরি শব্দটার চেয়ে অসুন্দর শব্দটা অনেক শুনতে ভালো লাগে। বিচ্ছিরি শব্দটা বড় শক্ত। আমাকে অসুন্দর বললেই হত।’
‘কাকের কথায় কোকিল লজ্জা পেল । সে অনুতপ্ত গলায় বলল, তোমাকে আঘাত দেবার জন্য আমি দুঃখিত!’
কাকটা এবার হেসে ফেলে বলল , ‘ আরে আমি এ নিয়ে মন খারাপ করিনি। কারন তোমার আচরণ তোমাকে ছোট করবে। তোমার ভুল শব্দ চয়ন তোমার ক্ষতি করবে, আমাকে নয়। তবে এই ভালো যে তুমি বুঝতে পেরেছ, অনুতপ্ত হয়েছ। আচ্ছা এবার বল ,তুমি উড়তে পার কেমন?’
এই দুইদিনে দেখলাম ভালো উড়তে পারছি। কেন বলত?’
কাক বলল, ‘ছোটদের বেশি দূরে যেতে নাই । তবুও তুমি আমার সাথে যেতে পার। যেখানে গেলে তোমার সুন্দর আর অসুন্দর নিয়ে ভুল টা ভাঙ্গবে।’
কোকিল বিস্ময়ের সাথে বলল , ‘সত্যি কি তুমি বলতে চাচ্ছ ,আমি তেমন সুন্দর নই !’
কাক হেসে বলল ,আমি উড়ে যাচ্ছিলাম। তোমার অসম্ভব সুন্দর গলার স্বর শুনে এই ডালে বসেছিলাম। তুমি সুন্দর এবং প্রত্যেকেই সুন্দর।’
একটু থামল কাক। যেন কিসব ভাবছে। তারপর তেমনি হেসে বলল, চল , এই দুই গ্রাম পরে একটা জঙ্গল আছে। সেখানে চল যাই। সেখানে অনেক অনেক পাখিরা থাকে। এখানে নিরাপদ না। এই জায়গাটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। আর মানুষের ভিতরে মায়া দয়া আগের মতন নেই। যার মায়া নেই, তার ভিতরটা শূন্য, কেবল সে বুঝতে পারে না। মানুষেরা ভয়ানক ভাবে বদলে যাচ্ছে। আহ! কেউ যদি তাদের বুঝাতে পারত!’
কোকিল বলল, তুমি তো ভারী সুন্দর করে কথা বলতে জানো!’
কাক বলল, একদিন তুমিও পারবে। আগে বড় হও। আর মায়া দিয়ে দেখ চারদিক। দেখবে সব আপন। সবই তোমার নিজের। মায়া তমার ভিতর বাসা বাঁধলেই তুমি যত্ন নিতে শিখবে, আদর করতে শিখবে, ভালোবাসতে শিখবে। আচ্ছা এবার আমার যাবার পালা। যদি সাহস কর ,তবে আমার পিছু নিতে পারো। তবে আমি তোমাকে জোর করব না। কারন জোর করে নিলে, পরে তুমি আমাকে ভুল বুঝতে পা্রো। কিছুখন ভেবে তারপর ঠিক করো বা আমি আগামী কাল আসব। তখন ঠিক করে নিও কি করবে।’
বেশ কিছুক্ষণ পাশে থেকে কাক উড়ে গেল। কোকিল কয়েক মুহূর্ত কিসব ভাবলো। তারপর উড়ে গেল কাকের পিছু পিছু।
তখন বিকাল । যখন ওরা জঙ্গলে পৌছালো। কোকিল বিস্ময়ে আর মুগ্ধতার সাথে দেখল, কত বিচিত্র সব ছোট বড় পাখি ! কি অবিশ্বাস্য সুন্দর সুন্দর রং তাদের ! কি অপূর্ব সুন্দর সুন্দর সেই সব পাখি ! আর নানান ধরনের ছোট বড় অসংখ্য গাছ । হতভাগা দুষ্ট মানুষ কি জানে এই গাছের কথা ! জানলে তো সর্বনাশ ! এখানেও তারা পৌছে যাবে, কেটে ফেলব সব গাছ! কোকিল ভয় পেল। তবে চারদিকে তাকাতে তাকাতে মানুষের কথা ভুলে যেতে লাগল। যেন মানুষ নিয়ে ভাবনাটা ভাবল বটে তবে জঙ্গলের সৌন্দর্য ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত পরেই।
সন্ধ্যা নেমে এলো। জঙ্গলের একটা গাছে কোকিল আর কাক আশ্রয় নিয়েছে । অচেনা জায়গার অন্ধকার কোকিলকে ভীত করতে পারেনি । তার মাথায় অনেক প্রশ্ন আর বিস্ময় নড়েচড়ে বেড়াতে লাগলো!
কোকিল চিন্তার জগতে ডুবে গেল। ভাবতে ভাবতে সে যেন হঠাৎ করে আবিস্কার করল, আমি সুন্দর বা কম সুন্দর, এসব ভাবনায় কি আসে যায় ! আমি তো আমাকে বানাইনি ! যা কিছু আমার বলে এতদিন ভেবেছি তাতো আসলে আমার নয়। আমার তো নয়! কেবল আমার কথা , কাজ আর আচরণ ছাড়া ! কাক দেখতে কতইনা অসুন্দর । অথচ সুন্দর করে কথা বলে। তবে তো সে ভালো। সে ভালো আমার চেয়ে । কারন আমি অসুন্দর করে ভাবি। বাজে বাজে শব্দে কথা বলি বা রেগে কথা বলি!
অন্ধকারে কাক প্রশ্ন করল , ‘ তুমি কি ভয় পাচ্ছ ?’
কোকিল অন্ধকারে কাক কে দেখতে পেল না । সে মৃদু হেসে বলল , ‘ না । ভয় কিসের! আমি ভাবছি ,আমি কি বোকা ছিলাম যে নিজেকে নিয়েই ভাবতে শিখেছিলাম। আমি আজ জেনেছি , নিজের দেখার মধ্যে বড় কোন আনন্দ নেই । নিজেরটা বড় করে ভাবার মধ্যে বড় কোন আনন্দ নেই। আনন্দ আসলে জানার মধ্যে, শিখার মধ্যে।’
কাক হেসে বলল , বাহ্যিক সৌন্দর্য হচ্ছে সৃষ্টকর্তার দান । আর অন্তরের সৌন্দর্য নিজের! বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে বড়াই করার কিছু নেই। এই যে তুমি সুন্দর সুন্দর পাখি দেখছ, তার মধ্যে বয়স্ক পাখিগুলোও দেখেছ। বয়স তাদের সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে। এক সময় তোমার আমার সৌন্দর্যও কেড়ে নিবে। কিন্তু মনের যে শিক্ষা বা জ্ঞান তা কেউই কেড়ে নিতে পারবে না। একটু থমে কাক বলল , ‘এই যে বিশাল পৃথিবী তা আমাদের সব সময় জানায় , এসো , দেখো ! উপভোগ করো এই পৃথিবীর যত দুঃখ আর আনন্দগুলো তাই নিজের কথা নিয়ে পড়ে না থেকে উপরের আকাশটাকে মন ভরে দেখো!’
মোঃ নোমান সরকার
এক দেশে দুই জন যমজ যুবক ছিল । তার নাম ছিল জাহিন আর মাহিন। একদিন তার দেশে অনেক দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। তারা দুই ভাই একই জায়গায় চাকরি করত। আর একই সাথে তাদের চাকরি হারালো। একদিন দুইদিন করে অনেক দিন কেটে গেল কিন্তু কোন কাজ খুজে পেল না। অবশেষে তারা ঠিক করল , চুরি করবে।
এদিকে যায় , সেদিকে যায় । বুঝে উঠে পারল না কোথায় চুরি করবে! একদিন তারা ঠিক করল চুরি যদি করতেই হয় তবে রাজার বাড়িতে চুরি করবে। যেই বুঝা সেই কাজ ! তারা দুই জন মিলে বুদ্ধি বের করল আর রাজপ্রাসাদে চুরি করতে গিয়ে রাজার প্রিয় গলার মালা নিয়ে আসলো।
পরের দিন রাজ্যময় সবাই জানল, রাজার প্রিয় গলার মালা চুরি যাবার কথা। কিন্তু অবাক কান্ড কিছু দিন পরে আবার রাজা নিজে তার বিছানায় গলার মালাটা পরে থাকতে দেখল! এ যে অবিশ্বাস্য! যে চুরি করেছে সে তা ফিরিয়ে দিয়েছে! এদিকে রাজা হুলংকার দিয়ে সবাইকে বললেন ,’’এত এত সৈন্য আর প্রহরীর মধ্য থেকে কিভাবে ঘটনাটা ঘটল!’’
তদন্ত পর তদন্ত হতে লাগল। কিন্তু তদন্তের ফলাফল শূন্য! রাজা ক্ষেপে গিয়ে বললেন ,’’এটা যে করেছে সে বা তারা তো রাজাকেও মেরে ফেলতে পারত ।‘’ রাজা সেদিনই আদেশ দিলেন নতুন রাজপ্রসাদ বানানোর জন্য। আরও নতুন নতুন কৌশল নিলেন এই ভয়ংকর চোর ধরার জন্য।
নতুন রাজপ্রাসাদ বানানো হল। রাজপ্রাসাদের চারদিকে বিশাল পুকুর খনন করা হল । বিশাল চওড়া করে বিত্ত আকারে সেই বিশাল পুকুরে অসংখ্য কুমির ছেড়ে দেওয়া হল। মাত্র কয়েকজন প্রহরী থাকে নতুন এই রাজপ্রাসাদে।
এরমধ্যে একটা খবর ছড়িয়ে গেল রাজা নাকি একটা হীরার টুকরো রেখেছেন নতুন রাজ প্রসাদের কোথাও । সে কথা জাহিন আর মাহিন শুনল। আরও শুনল বিশাল পুকুর আর কুমিরের কথা। তারা ভাবতে বসল কিভাবে আবার সবাই কে বোকা বানিয়ে হীরাটা চুরি করা যায়। যেই বুঝা সেই কাজ। সন্ধ্যার পর পর জাহিন হাজির হল রাজপ্রসাদে।
কিছুখন পরেই সে দেখতে পেল প্রাসাদের উচু জায়গা থেকে রাজাকে। রাজা পায়ে হেঁটে প্রাসাদের এক কোনায় একটি আলাদা বিশাল ঘর আছে। রাজা সেই ঘরে ঢুকলেন। এভাবে জাহিন পরপর দুই দিন সন্ধ্যার পরে এসে দেখল রাজা সেই বিশেষ কোনার ঘরটায় ঢুকেন । আর সেই ঘর থেকে বের হন অনেক রাতে ! জাহিনের সন্দেহ হল ,এটা কি সেই জায়গা যেখানে হীরাটা রাজা লুকিয়ে রেখেছেন ! হতে পারে , খুব হতে পারে !
দ্বিতীয় দিনের রাতে সে দেখল রাজা ঢুকল কিন্তু দরজাটা একটু ফাঁকা ! সে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল ! তারপর নেমে এলো প্রাসাদের ছাদ থেকে। তারপর ঢুকে গেল ঘরের ভিতর। ঘর তো নয় এ এক ভিন্ন ধরনের তিন তলা প্রাসাদ। এখানে আছে শুধু বই আর বই । এ যেন এক বই এর নগরী ! ছোট বড় আলমারিতে কেবলই বই । জাহিন তখনই শুনতে পাচ্ছে রাজার গলা। রাজার গলা সে অনেকবারই সে শুনেছে । প্রজাদের মধ্য অনেক বার গিয়েছেন রাজা। রাজার গলা শুনে জাহিন সব ভুলে এগিয়ে গেল নীচের দিকে । আরও স্পষ্ট ভাবে শুনল ,রাজা জোরে জোরে বলে যাচ্ছে , ‘’ অ ,আ ,ই ,ঈ ,ও ! অ,আ,ই,ঈ ,ও ! অ,আ,ই,ঈ,ও !’’
রাজা পড়ছেন ! জাহিন যতটা সম্ভব সাবধানে কাছে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখলেন ,রাজার পাশে একজন বৃদ্ধ লোক বসে আছেন। তিনি রাজা কে পড়াচ্ছেন। আর রাজার হাতে বই। তিনি পড়ে চলেছেন! দুই জনই খুব মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন বই এর দিকে !
জাহিন পড়াশুনা করেনি। কিন্তু মক্তব আর টোল দেখেছে । কিন্তু রাজা কি ছোট বাবু যে রাজা এসব পড়বে! তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। জাহিন একটা আলমারির পিছনে লুকিয়ে আছে অনেক খন ধরে। সে দেখল রাজার চলে যাওয়া। আর দেখল বৃদ্ধ শিক্ষককে নীচে চলে যেতে। বৃদ্ধ শিক্ষক যেতেই সে বেড়িয়ে এলো। তারপর একটা করে বই এর পাতা উল্টাতে লাগল। নিশ্চয় এই ঘরের কোন এক বইতে বা আলমারির কোথাও লুকান থাকতে পারে হীরাটা।
বেশ অনেক খন পেরিয়ে গেল হীরা পাওয়া গেল না। জাহিন বুঝল এই ঘরে হীরা নেই । এখান থেকে বেড়িয়ে মূল প্রাসাদে ঠুকবে বলে ঠিক করল। ঠিক তখনই বৃদ্ধ মানুষটির হেঁটে আসার শব্দ পেল । জাহিন দূর থেকে দেখল বৃদ্ধের হাতে একটা বই। বৃদ্ধ উঠে এলো। জাহিন লুকাল একটা আলমারির পিছনটায় । বৃদ্ধ বসল কাছের একটা টেবিলে , বই খুলে পড়তে লাগল। জাহিন বুঝল ,চট করে এখান থেকে বের হওয়া যাবে না। সে অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পরল।
কে যেন ঘুম ভাঙ্গল তখন জাহিন দেখল তার হাত পা বাধা ! লাফিয়ে উঠতেই পরে গেল। দেখল বৃদ্ধকে আর পাশে দাঁড়িতে মিটি মিটি হাসছে রাজা । ভয়ে আবার লাফ দিতে গেল। রাজা সব শুনল। দুর্ভিক্ষের কারনে মানুষ চুরি ,ডাকাতি করছে জেনে মন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়ে সে এলাকায় নতুন কাজ যেন তৈরি হয় ,তার ব্যবস্থা করল।
এবার বিচারের জন্য রাজ দরবারে হাজির করা হল জাহিন কে। কি করে এই রাজ প্রসাদে ঢুকতে পারল তার ব্যাখ্যা দিল সে। শুনে রাজা সহ সবাই অবাক।
জাহিন বলল , রাজ প্রসাদের উপরে এখন ঝুলে আছে একটা দড়ি। সেই দড়ির শুরুটা বহু দূরে। দড়ির শুরু লাগান আছে একটা বিশাল বট গাছে ।
মন্ত্রী বলল ‘’রাজা মশাই ও এগুলো কি বলছে ,কিছুই বুঝতে পারছি না।‘’
জাহিন আবার শুরু করল ,আমরা দুই ভাই একটা ঘুড়ির দোকানে চাকরী করতাম। একটা লম্বা মানুষ যতটা বড় আমাদের ঘুড়ি গুলো ততো বড় বড়। আমরা দুই ভায়ের কাজ ছিল ক্রেতাদের ঘুড়ি উড়িয়ে দেখানো। বড় গাছের সাথে বেঁধে ওগুলি নিয়ন্ত্রন করতাম। আমার আরেক ভাই মাহিন গাছে দাঁড়িয়ে দড়ির গোড়ার ধরে হাত আর পা দিয়ে উড়তে থাকা ঘুরি নিয়ন্ত্রন করত। আর আমি ঘুড়ির সাথে উড়ে চলতাম। দড়ির দুই হাত নীচে নীচে একটা করে গিট দেওয়া থাকত । তা দিয়ে আমি নীচে উপরে আসতে পারি। একদিন তার দেশে অনেক দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। আর আমরা চাকরী হারালাম। চাকরী হারিয়ে যখন ঠিক করলাম রাজার বাড়িতে চুরি করব। তখন এই পদ্ধতি কাজে লাগালাম। তবে রাজার গলার মালা চুরি করে আবার তা ফিরিয়ে দিলাম। আসলে আমরা চোর না। আমরা চুরি করেছি আমাদের গ্রাম গুলি খুব বড় ধরনের বিপদে আছে তা রাজা কে জানাতে। রাজার মনযোগ কাড়তে! সব শুনে রাজ সভার সবাই যেন ভড়কেই গেল। এত বুদ্ধি মানুষের হয়!
সবাই রাজার কাছে মিনতি করল চোর কে ক্ষমা করার। রাজা সব ভেবে রাজা জাহিনকে আর মাহিনকে ক্ষমা করে ঠিকই কিন্তু তিন মাস একটা বাড়িতে বন্দী করে রেখে তাদের পড়ালেখার সুযোগ করে দিলেন।
রাজা তাদের জ্ঞান বুদ্ধি সাহস নিয়ে ভাবতেই আবাক হলো। অবাক হলো তাদের চুরির কৌশল নিয়ে। আর ঠিক করল, তাদের রাজকর্মচারী হিসাবে নিয়োগ দিতে। রাজা মন্ত্রীদের সাথে এ নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন। আলোচনা করলেন বৃদ্ধ শিক্ষকের সাথেও।
পরের দিন রাজা এলো জাহিন আর মাহিনকে দেখতে। রাজা বলল , আমাকে দেখেছ পড়তে । জাহিন আর মাহিন বলল ‘হ্যা ।‘
রাজা এক গাল হেসে বলল , আমি রাজা! পড়াশুনা করি প্রজাদের সুখের জন্য।তাই আমি শুরু করেছি ,তোমরাও করো। এসো আমরা পড়াশুনা করি। আর সুখে থাকি ,এই সুখের রাজ্যে !
বেশ কয়েক দিন পরে জাহিন আর মাহিন প্রায় মুখস্ত করে ফেলেছে অ আ । জাহিন মাহিন কে বলল , দেখ ঠিক হয়েছে কিনা । অ আ ই ঈ উ ঊ !
মহিন আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠল ।।