মোঃ নোমান সরকার
গল্পটা শুরুর আগে কিছু কথা বলতে চাই আমার কিশোর বন্ধুদের। আমাদের শিক্ষার্থী বন্ধুদের ভিতরে প্রায়ই কিছু প্রশ্ন জাগে যে, জ্ঞান বিজ্ঞানের বড় বড় সব অবদানই তো পশ্চিমাদের। আমাদের এশিয়ানদের ভুমিকা কি কিছু আছে? আমরা তো কেবল তাদের অবিস্কার ভোগই করে যাচ্ছি, এখানে আমাদের অবদান কি? এই সভ্যতা এতে আমাদের এশিয়ানদের কি কিছু নেই! সবই দিক থেকে ফাষ্ট তো এমেরিকা, ইউরোপ। সব আবিষ্কারই তারাই করে যাচ্ছে। বিষয়টা আসলে তেমন না। এর যথেষ্ট উত্তর আছে আমাদের কাছে। ইতিহাস এর লাখো উত্তর রেখে দিয়েছে। তোমাদের কেবল জেনে নিতে হবে ইতিহাস থেকে, আমরা কারা। ইতিহাস পড়ার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের মানুষিক ভাবে দুর্বল যেমন ভাব না। তেমনি নিজেদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। আর আজ এই উত্তরের একটি অংশ আমরা খুঁজে পাব হালাকু খান দ্বারা বাগদাদ পতনের ঘটনা জানার মধ্য দিয়ে।
আজ এমেরিকার বড় বড় শহর বা ইউরোপের দেশগুলোর বড় বড় শহর যেমন, তেমনি ছিল একদিন ইরাকের বাগদাদ, যুগের পর যুগ। ৭৬২ সালে খলিফা মনসুর আরব্য রজনীর এই নগরীটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযোয়ী বাগদাদ ছিল সম্পূর্ণ বৃত্তকার এবং চতুর্দিকে পরিখা বেষ্টিত। পরিখা মানে বুঝ তো বন্ধুরা? পরিখা মানে শক্রদের হামলা থেকে নিজ ভুমিকে বাঁচাতে সামরিক ঘাঁটির চারদিকে চওড়া আর গভীর ভাবে গর্ত তৈরি করে রাখা।
যাই হোক বন্ধুরা, ৭৬২ থেকে ১২৫৮ সাল, এই সময়টায় বাগদাদ ছিল ইসলামী স্বর্ণ যুগের প্রানকেন্দ্র, পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগর, মুসলিম বিশ্বের রাজধানী। জ্ঞান বিজ্ঞানে, শিল্প সাহিত্য, সম্পদ, প্রাচুর্যে সাড়া দুনিয়ার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ নগর। জ্ঞান, বিজ্ঞানে উজ্জ্বল এক তারায় পরিনত হয়েছিল এই নগর। দুনিয়ার সব জ্ঞানীরা ছুটে এসেছিল এখানে। আর জ্ঞানীরা ছুটে আসবেনা বা কেন। সারা দুনিয়া থেকে জ্ঞান বিজ্ঞানের বই এনে জমা করা হয় এখানে। আবার সেই সব বই অনুবাদ হত এখানে। অনেক অনেক দুর্লভ বই এর সংগ্রহ ছিল সেই বাগদাদে। দারুল হিকমা লাইব্ররী সহ অগনিত ছোট বড় লাইব্ররী হয়ে উঠেছিল জ্ঞানের ভিন্ন এক সমুদ্রে। দুনিয়ার বিভিন্ন ভাষার বই অনুবাদের জন্য বিখ্যাত কেবল না, আমরা বলতে পারি যে, দুনিয়া আজকের জায়গায় পৌঁছাতে পারত না এই বইগুলোর অনুবাদ না হলে,জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে গবেষনা না হলে। আমাদের আজকের সভ্যতা কতটা ঋণী যখন ইতিহাস পড়বে তখন আরো আরো জানবে। জেনে কেবল অবাক আর বিস্মিত হতে হবে।
জৌলুসে ডুবে থাকা স্বপ্নের বাগদাদ নির্মাণ হওয়ার পর কেটে গেছে ৫০০ বছর। এর জৌলুস কেবলই বেড়েছে। এর উচ্চতা আর গৌরব সমুজ্জ্বল ছিল হালাকু খানের আক্রমণে ধ্বংস হবার পূর্ব পর্যন্ত। পৃথিবী থমকে গিয়েছিল মধ্যযুগে হালাকু খানের এক অভিযানে। সাত দিনে যোল লক্ষ মানুষ হত্যা করে আর লাইব্ররীগুলোর সমস্ত বই পুড়ে ছাই করে দিয়েছিল মোঙ্গলা।
হালাকু খানের পরিচয় (১২২৮- ১২৬৫), তিনি দুর্ধর্ষ বিজেতা চেঙ্গিস খানের নাতি। চেঙ্গিস খানের চার পুত্রের এক পুত্র তোলুইয়ের সন্তান। মা সোরগাগতিক ছিলেন একজন প্রভাবশালী কেরাইত শাহাজাদি। তিনি ছিলেন নেস্টরিয়ান খ্রিষ্টান। আর হালাকু খানের স্ত্রী দকুজ খাতুন এবং তার ঘনিষ্ট বন্ধুও সেনাপতিও খ্রিষ্টান ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেছিলেন বলে জানা যায়। তার ভাই ছিলেন আরিক খান, মংকে খান ও কুবলাই খান। হালাকু খানের আপন ভাই মংকে গ্রেট খান থাকা অবস্থায় তাকে মোঙ্গল সম্রজ্যের দক্ষিণ পশ্চিম অংশ দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর সেই রাজ্যের পাশেই ছিল আব্বাসীয় খিলাফতের সীমানা। ১২৫৫ সালে ভাই মংকে গ্রেট হালাকু খানকে দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম অঞ্চল জয়ের জন্য প্রেরণ করেন। তবে ইতিহাসের এই বেদনাদায়ক ঘটনা বলে দেয়, এই শেষ সময়টা বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের প্রাণ কেন্দ্র জৌলুসে ডুবে থাকা বাগদাদ তখন ভোগ বিলাস আর অন্তরকোন্দলে ক্ষতবিক্ষত ছিল। ধর্মীয় বিষয়তেও নানান ভ্রান্ত ধ্যান ধারণার এত জোরাল হয়ে উঠে যে চরম বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। ছোট্ট ছোট্ট বিষয়ে নানান মতভেদ সমাজকে প্রবল অস্থিরতা নিয়ে গিয়েছিল। আর সেই সময় আরব রাজ্যো পরিনত হয়ে ছিল যেন ছোট ছোট রাজ্যে। আর ছিল অন্তকোন্দল, চরম ভোগবিলাসে মত্ত। সকল ধরনের বাড়াবাড়ির যে অশুভ পরিনতি আছে তা আমরা বাগদাদের পতনের ভিতর দিয়ে জানতে পারি। এই সময়ে বাগদাদের খলিফা ছিলেন নখ বিহীন সিংহ খলিফা আল মুস্তাসিম বিল্লাহ।
মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপে নিষ্ঠুর মোঙ্গলরা তাতার বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। হালাকু খান সামরিক অভিযানেরমূল কারন ছিল, পারস্যের ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠা রাজনৈতিক আততায়ীয়র দল গুপ্তঘাতক সম্প্রদাইয়কে দমন। এরা এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল আর গুপ্ত হত্যা এতটাই ব্যাপক হয়ে উঠেছিল যে মোঙ্গলরাও এদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থের অশংকা করছিল এবং আব্বাসীদের রাজধানী বাগদাদ দখলের আগ্রহ। বাগদাদের জৌলুস, সম্পদের প্রতি বহুকাল থেকে মোঙ্গলদের লোভ ছিল। তাই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তারা। অন্তঃকলহে দুর্বল ছিল বাগদাদ, এই তথ্যগুলোই বাগদাদ আক্রমণের জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠে মোঙ্গলদের কাছে। এদিকে গুপ্তঘাতক সম্প্রদাইয়ের চল্লিশটির বেশি খুবই শক্তিশালী দুর্গ আক্রমণে কোন এক সময় বাগদাদের সাহায্য আশা করলে বাগদাদের খলিফা হালাকু খানকে সাহায্য প্রদানে বিরত থাকে। এতে প্রবল আক্রেশের জন্ম নেয় বাগদাদের প্রতি।
জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি, বিত্ত বৈভবে অন্যন্য বাগদাদ কেবল দুর্বল হয়ে উঠে আব্বাসীদের নিজেদের ভিতরের অন্তঃকোন্দলে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনায়। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা এত দুর্বল হয়ে উঠে যে সৈনিকেরা বেতন ঠিক মত পেত না। ফলে সমস্যায় জর্জরিত সেনাবাহিনী। আর ধর্মীয় বিষয় নিয়ে মতভেদ আর পাশাপাশি শিয়া সুন্নী বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছিল। খলিফার শিয়া উজির বিশ্বাসঘতকাতা করে মঙ্গলদের বাগদাদ আক্রমণের আহ্বান করে নিজ দেশের সকল তথ্য প্রদান করে যান। বিলাসী জীবনে ডুবে থাকা দুর্বল খলিফা বুঝতেই পারেননি কি ঘটতে যাচ্ছে।
হালাকু খান খলিফাকে কাপুরুষ আখ্যা দিয়ে মঙ্গলদের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা চিঠি পাঠিয়ে আত্ম সমর্পণ করতে বললে খলিফা তা প্রত্যাখান করেন। আর খলিফার শিয়া উজির খলিফাকে বুঝাতে সক্ষম হয়, অর্ধেক সৈন্যকে মঙ্গলদের প্রতিহত করতে। বিষয়টি আমাদের সিরাজদৌল্লাহ প্রধান সেনাপতি মীরজাফরকে বিশ্বাস করার মতনই ঘটনা ঘটে। বন্ধুরা জানত,১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধে যখন বাংলার ভাগ্য নির্ধারণ হচ্ছিল, তখন বাংলার প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের আদেশে পলাশীর যুদ্ধে ৫০ হাজার সৈনিক নিস্ক্রিয় ছিল। তারা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, কি নির্মম ভাবে ক্ষুদ্র একটি দলের কাছে বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজয় বরন করেন। আসলে সকল নিষ্ঠুর পরিনতির পিছনে নিজেদের মানুষই কাজ করে। পিছন থেকে তারাই ছুরি মারে। তাই বন্ধু নির্বাচন বা যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু, সেই মানুষকে নির্বাচিত করতে হয় অনেক বুদ্ধি, বিবেচনার মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে পরিবার হল ক্ষুদ্র রাষ্ট। আর পরিবার মানে বাবা মা, ভাই বোন, আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধব মিলে। এরা প্রত্যেকেই পরিবারের অংশ। তাই বিনয়, শ্রদ্ধা, মমতা, ভালোবাসা, আদর, সহানূভুতি দিয়েই প্রত্যেককে দেখতে হবে। যাতে অন্তকোন্দলের কোন সুযোগ না থাকে।
আচ্ছা আমরা ফিরে যাই ইতিহাসে আবার। ১২৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে হালাকু খান পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে বাগদাদ আক্রমণ করে বাগদাদের নগর ফটক অবরোধ করে। তার বাহিনীর তাতার, চীনা এবং মধ্য এশিয়ার সৈন্যদের দিয়ে অগ্নি গোলক নিক্ষেপ করে দুর্গ আর উঁচু প্রাচীর ধংস করে ফেলে। খলিফার ক্ষুদ্র ও দুর্বল সেনাবাহিনী হালাকু খানের যোগ্য বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয় অতি সহজেই এবং খলিফা তার সমস্ত ধন সম্পদ দিয়ে পরিবারবর্গ , আত্মীয়স্বজন এবং অনুচরবর্গ সহ আত্মসম্পরণ করতে বাধ্য হয়। তবে এতে রেহাই পায়নি কেউ। প্রত্যেককে হত্যা করা হয় এবং খলিফাকে কম্বলে পেঁচিয়ে মোঙ্গলিয়ান তেজি ঘোড়ার পা আঘাতে হত্যা করা হয়।
হালাকু খানের মোঙ্গল বাহিনী হত্যা করতে থাকে সাত দিনে অথবা তের দিনে বিশ লাখ নগরবাসীর মধ্যে ষোল লাখের মতন নগরবাসীকে। এদের হাজার হাজার নাগরিকদের হত্যা করে তাদের মাথার খুলি দিয়ে পিরামিড বানান হয় মঙ্গোলরা। বিশ লক্ষ নগরবাসীর মধ্যে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ এই হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে গিয়েছিল হালাকু খানের স্ত্রী ডোজুজ খাতুনের কারনে। আর মোঙ্গলদের গুপ্তচর হিসাবে থাকা দুই জন শিয়া মন্ত্রীদের কারনে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেঁচে যায়। ইতিহাস বলে শিল্পী, চিত্রকর, শিয়া সম্প্রদায়, খ্রিষ্টান সম্প্রদাইয়ের মানুষ জন এই আক্রমন থেকে রেহাই পেয়েছিল, আর মরতে হয়েছিল কেবল মূলত সুন্নী মুসলমানদের।
মোঙ্গলরা শুরুতেই নগরে প্রবেশ করে নগরবাসিকে অস্ত্র সমর্পণের আদেশ দেন। আর নগরবাসীর অস্ত্র সমর্পণের পরেই শুরু হয় হত্যা। নারী, পুরুষ, শিশু,বৃদ্ধ কেউ পালিয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। হত্যাকাণ্ড এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে তিন দিন ধরে নগরীর পথে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল এবং তাইগ্রীস নদীর পানি মাইলের পর মাইল রক্তে লাল হয়ে ছিল। কেবল হত্যাই করেনি, নগরীতে থাকা প্রতিটা দালান, হাসপাতাল, প্রতিটা লাইব্রেরি, মসজিদ সব পুড়ে ছাই করে দিয়েছিল। পুড়ে ফেলা হয়েছিল দৃষ্টিনন্দন সব ভবন। পুড়ে দেওয়া হয়েছিল শতশত বছরের গড়া উঠা শিল্প সাহিত্য, মুসলিম জ্ঞান- বিজ্ঞান , শিক্ষা সংস্কৃতির উজ্জলতম যা কিছু নিদর্শন ছিল, সব কিছু। ফলে চিকিৎসা সহ জ্ঞান বিজ্ঞানের নানান গবেষনামূলক অমূল্য সব বই আর সব লাইব্রেরিতে থাকা ৫০০ বছরের সংগ্রহে থাকা হাজার হাজার বছরের সব বই পুড়ে ফেলা হয়। ব্যতিক্রমধর্মী স্থাপত্যকলায় গড়ে উঠা ৫০০ বছরের বাগদাদকে পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে এমন ভুতরে নগরীতে পরিনত হয়ে এটি এমন ভাবে ধংস করা হল যে এর কোন একটি স্মৃতি চিহ্ন রাখা হয়নি। আজ অব্দি এটি আর দাঁড়াতে পারেনি। শিক্ষিত বাগদাদবাসী আজও অশিক্ষা আর কুশিক্ষায় ডুবে আছে।
বাগদাদ শংস নিয়ে ঐতিহাসিক ব্রাউন বলেন,’ সম্ভবত কখনোই এত বড় ও সমৃদ্ধশালী একটা সভ্যতা এত দ্রুত অগ্নিশিখায় বিধ্বস্ত ও রক্তধারায় নিশ্চিহ্ন হয়নি।‘
মৃত্যুর আগে হালাকু খান তার সময়কালে এত মৃত্যুর জন্য অনুতপ্ত হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেছিলেন সম্রাট অশোকের মত। ১২৬৫ সালে জালিম অহংকারী হালাকু খান মৃত্যুবরণ করেন। এর আগেই মোঙ্গল বাহিনীর পতন ঘটে মিশরের মামলুক সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজের এলিট সেনাবাহিনীর কাছে। এই পতনের মধ্য দিয়ে মোঙ্গলরা দুর্বল হয়ে যায়।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে মোঙ্গলরা ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর। ফিলিস্থিনির আইনজালুতের ঐতিহাসিক প্রান্তরে যদি সেদিন হালাকু খান হেরে না যেত তবে উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ পরিনত হত বাগদাদ,সমরখন্দ,বেইজিং এর মত ধ্বংসস্তূপে। হালাকু খানের মৃত্যুর কারনে পতন থেকে বেঁচে গিয়েছিল উত্তর আফ্রিকা আর ইউরোপ। এক বাগদাদ ধংস করে গোটা মানব সভ্যতার যে ক্ষতি মোঙ্গলরা করে গেছে মধ্যযুগে সেই ক্ষত আর হাজার বছর বয়ে নিতে হবে আমাদের প্রত্যেককে। আমরা ধারণাই করতে পারি না বাগদাদ ধংস না হলে আজকের সভত্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত।
ঐতিহাসিক ইবনুল আমীর বলেন,’পৃথিবী এবং বিশেষত মুসলমানদের ওপর যে সব বিরাট বিপর্যয় ও ভয়াবাহ ধ্বংসলীলা সংগঠিত হয়েছিল তার মধ্যে তাতার জাতির আক্রমণই অন্যতম।‘
মূলত বাগদাদ আক্রমণের পরে মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞানে অবদান ক্রমাগত হ্রাস পায়। পতন হয় মধ্য এশিয়ার। বন্ধুরা আমরা তাই এই কারনে দেখতে পাই না জ্ঞানে বিজ্ঞানে এশিয়ানদের অনেক বড় সব অবদান।
এসো এবার পুরো লেখাটা নিয়ে পর্যালোচনা করি। আগে কিছু কথা তোমাদের জেনে রাখা দরকার যে, আমরা সময়ে আমরা যখন ইতিহাস পড়তাম তখন স্কুলে একটা ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকত আর কলেজে উঠে পেতাম পুরো ইতিহাস। শত শত বছর কিন্তু এভাবেই চলেছে। কিন্তু তোমাদের এই সময়টা ভিন্ন। অন লাইনের কল্যাণে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ইতিহাসের একই বিষয় নানান ভাবে জানার সুযোগ হচ্ছে আজ। ফলে কখনো কখনো নিজের ভিতরেও বিতর্ক বাড়ছে।
এবার আমি মূল পর্যালোচনায় আসি। আমি উপরে উল্লেখ করেছি বিশ লক্ষ নগরবাসীর মধ্যে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ এই হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে গিয়েছিল হালাকু খানের স্ত্রী ডোজুজ খাতুনের কারনে। হালাকু খানের স্ত্রী ডোজুজ খাতুন যদি প্রক্ষাপটে না থাকত তবে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ভাগ্য তাই হত যা সুন্নী মুসলমানদের ক্ষেত্রে হয়েছে। আর শিয়া মন্ত্রীদের নিজ রাষ্ট্রের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে মোঙ্গলদের সাথে যোগাযোগ যদি না থাকত তবে তাদের ভাগ্যেও তাই হত। বাগদাদ আক্রমণের আগে পারস্য আক্রমণে মোঙ্গলরা পারস্যের শিয়াদের হত্যা করে এসেছিল। মোঙ্গলরা কাউকে রেহাই দেয় না, এটি তাদের চরিত্র। তাহলে পুরো ঘটনায় মূল ব্যর্থতা কার? ব্যর্থতা মুলত খলিফার। অথচ আমরা সেই বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশীদ,আল মনসুর, আল মামুন রাজ্যের কল্যাণে ঘুরে বেড়াত, কিসে রাজ্যের মঙ্গল হয় এই নিয়ে তারা ছিলেন বলে বাগদাদ আরব্য রজনীর দেশ হতে পেরেছিল। বাগদাদ তৈরি হয়েছিল বহু শ্রমে আর ঘামে। অথচ আমরা জানলাম সেই আব্বাসীয় বংশের খলিফা হয়েও নখ বিহীন সিংহ খলিফা আল মুস্তাসিম বিল্লাহ ছিল আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত। সে একজন খলিফা বা রাজা এ নিয়ে দায়িত্বশীল কোন আচরণ তার ছিল না। সৈনিকরা তার সময় বেতন ঠিক মত পেত না অথচ রাজকোষে অর্থের কোন ধরনের অভাব ছিল না। এই উঁচু একটি রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর দরকারি বা কি এমন অভেলা তাদের মধ্যে কাজ করছিল। খলিফার কোন গুপ্ত অনুচর বা নিজের গুপ্ত বাহিনী ছিল না। ছিল না বলে শিয়া মন্ত্রী যে তথ্য মোঙ্গলদের নিকট পাঠাচ্ছিল বা রাষ্ট্রের সাথে ষড়যন্ত্রে মেতে ছিল তা তিনি জানাতে পারেননি। এমনকি মোঙ্গল্রা যখন অপমান জনক চিঠি পাঠায় তারপরেও সে বলতে গেলে অর্ধেক সৈন্য মোতয়ায়ন করে শিয়া মন্ত্রীর পরামর্শে। মোঙ্গলরা যখন পারাস্য আক্রমণে তার সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। তারপর যখন মোঙ্গলরা বাগদাদের দিকে এগিয়ে আসছিল তখন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাহায্য চাওয়া উচিত ছিল। সামরিক বিষয়ে আরো শক্ত পদক্ষেপের দরকার ছিল। খলিফার তো স্পষ্ট করে জানার কথা মোঙ্গল কারা। হালাকু খানের দাদা চেঙ্গিস খানের হিংস্রতা না জানার কথা তো না। মোঙ্গলরা ছিল অপ্রতিরোধ্য আর বাগদাদের সেনাবাহিনী ভঙ্গুর অবস্থার বিবেচনায় খলিফাকে আর অনেক দায়িত্ববান হওয়া উচিত ছিল।
বন্ধুরা মনে রাখবে, অন্যকে দোষারোপ করে কোন সমস্যা থেকে বের হওয়া মানে নিজের বা নিজেদের ভুলগুলো এড়িয়ে যাওয়ার মানুষিকতা থাকে। তাতে সাময়িক লাভ হলেও অন্য সময় এর খেসারত দিতে হয়। বিষয়টা এমন যে, ‘সে খারাপ’ বলা মানে হচ্ছে আমি খুব ভালো। এটি খুব পুরানো একটা খেলা কিন্তু এই খেলার ভিতরে আগুন লুকিয়ে থাকে যা এক সময় নিজেকে পুড়িয়ে দেয়। যাই হোক, বন্ধুরা আমরা এই ইতিহাস থেকে কি শিখলাম, সেটি ভেবে বের করবে। তবে আমি আমারটা বলি, আমি শিখলাম, যাকে যখন যে দায়িত্ব দেওয়া হয় বা আমরা যারা যে দায়িত্ব নিব সেটি ফেলে অন্য কাজে মন দিব না। নিজ দায়িত্ব বা নিজের কাজ কখনো অন্যজনকে দিয়ে হয়না বা নিজে দায়িত্ব নিয়ে সেই দায়িত্ব অন্যকে দিয়ে করাতে চাইলে এর ফলাফল সব সময় মন্দ। কারন এতে যেটি হয় যখন কোন সমস্যা এসে দাঁড়ায় তখন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না বা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায়। এতে নিজের আর চারপাশের অনেকের অনেক ক্ষতি হয়ে যেতেও পারে। তাই আমরা যে দায়িত্ব নিব সেই দায়িত্ব বা কাজকেই ভালোবাসব। তবে তাতে আমরা প্রাণ খুজে পাব, মনযোগী হতে পারব। আর সেই কাজে মায়া আসবে, মায়া বাড়বে। মায়া ছাড়া কোন কাজ সফল হয়না। মায়াই নিজের ভিতর যন্ত্রশীলের মানুষিকতা তৈরি করে। আর যত্ন ছাড়া কোন জিনিস বা বিষয় টেকসই হয় না। জগতে যত্ন আর মায়াই যে কোন কাজকে উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে। এখানে একটি বড় বিষয় কিন্তু আমরা শিখে নিলাম বা জেনে নিলাম তা অন্তঃকোন্দলই হচ্ছে সব পারিবারিক সর্বনাশের মুল। তাই একে কখনো প্রশয় দেওয়া যাবে না। যে কম উপায় আমাদের ঝগড়া এড়াতে হবে। তবেই আমরা নিজেদের বেশি বেশি শ্রদ্ধা করতে পারব।
এই লিংকে থেকে সেই সময়ের বাগদাদ সমন্ধে আরো বেশি জানতে পারবে। এখানে বেশ চমৎকার কিছু তথ্য আছে। https://www.youtube.com/watch?v=ImqEg9zRyrQ