মোঃ নোমান সরকার
তাকে দেখে আমি খুশিতে এতই আত্মহারা হয়েছিলাম , নোমান।
আমার হৃদয়ের ভগ্নদশা যা দেখাতে আমি যুগ অপেক্ষায় ছিলাম, তাই প্রকাশ করা হল না।।
মোঃ নোমান সরকার
ছোট ভুতটি শব্দ করে কাঁদছে। বনের সব প্রানী, পাখির আর ছোট ছোট প্রান যারাই আছে তারা সবাই ভয়ে কাঁপছে। কারন একটাই এই ছোট ভুতটির মা খুবই ভয়ংকর। সে রেগে গেলে যাকে কাছে পায় তারই ঘাড় ভেঙ্গে দেয়। বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ, ঈগল, পিপীলিকা কেউ ভূতের কাছ থেকে রেহাই পায়নি।
ছোট ভূত মাকে খুঁজে পাচ্ছে না বলেই কাঁদছে।
বনের সব প্রানীরা জরুরী বৈঠকে বসেছে। কি করা যায়, কি করা যায়। কিন্তু বিকাল ফুরিয়ে গেলো। কেউ কোন বুদ্ধি দিতে পারল না, সিদ্ধান্ত তাই হলো না। যে যার বাড়ি ফিরে গেলো। নিজের জীবনই সবচেয়ে প্রিয়, কে যেচে জানটা হারায়।
একটা ফড়িং সেই সময় সেই বনের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। সে দেখলো, সবাই কেমন মলিন মুখে এক সাথে মিটিং ভেঙ্গে দিয়ে সরে যাচ্ছে। ব্যাপার কি, এই ভেবে সে সোজা নেমে এলো পিপীলিকার রাণীর কাছে।
কি হয়েছে? কি হয়েছে?
রাণী ধমকের সুরে বলল, যেখানে যাচ্ছ যাও, এই সব জেনে তোমার কাজ নেই।
ফড়িং চঞ্চল গলায় বলল, আমাকে বল না, কেন তোমরা সব প্রানী মলিন মুখে ফিরে যাচ্ছ?
পিপিলিকার রাণী বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না কারো চিৎকার, কারো কান্নার সুর?
হ্যা পাচ্ছি, আমি উত্তরটা পেলে সেই কথাও তমার কাছে জানতে চাইতাম, কে কাদে এভাবে?
পিপলিকার রানী বিরক্ত গলায় বলল, তুমি কেন বিরক্ত করছো।
আহা বলই না। ফড়িং আবদারের সূরে জানতে চাইলো।
এই বনে একজন ভয়ংকর ভূত বাস করে তার বাচ্চা সহ। সে রেগে গেলে কারনে অকারনে যাকে কাছে পায় তারই ঘাড় ভেঙ্গে দেয়। তার বাচ্চাটাই কাদছে। এখন যদি ভূত এসে বাচ্চাকে কাঁদতে দেখে, তখন যদি সে মনে করে এই বনের প্রানীদের কারনে তার বাচ্চাটা কাঁদছে তখন কি হবে? সে তো সবাইকেই মেরে ফেলতে পারে। আবার কেউ সেই বাচ্চাটার কাছে যেতেও ভয় পাচ্ছে। যখন যাবে তখনই যদি ভূতটা এসে পরে। তখন তার জানটাও তো যাবে। তাই না?
ফড়িং হতাশ গলায় বলল, এ তো দেখি বিরাট বিপদে পরেছো তোমরা। হ
মোঃ নোমান সরকার
রাজকুমারী দেখতে পেল একটা মানুষ পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। রাজকুমারীর মন ভাল ছিল না। সকালে সখীদের নিয়ে সে এসেছিল নদীর পারে। নদীর পারে এসেই মনে হল, একা থাকলেই তার ভালো লাগবে। তাই সে সবাইকে দূরে চলে যেতে বলল। জায়গাটা ছোট্ট একটা টিলার পাশে। আরো দূরে টিলার উপরের দিকে তার জন্য বিশেষ দেহক্ষীরা আছে। একটা পালকিতে চড়েই প্রতিবার এই জায়গাটায় সে আসে। কেন যেন খুব ভাল লাগে জায়গাটা।
রাজকন্যা খুব জোরে ডাকল,’ মিথিলা! মিথিলা!’
ডাক শুনতেই মিথিলা দৌড়ে এলো।
আমার দেহরক্ষীদের ডাকো। দ্রুত।
মিথিলা প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে উপরে উঠে গেল। আর যেন বাতাসের গতিতে দেহরক্ষীরা হাজির হল।
রাজকুমারী কঠিন গলায় বলল,’ঐ মানুষটারে টেনে নিয়ে এসো। মানুষটা ডুবে যাচ্ছে।‘
আট জনের জায়গায় তিনজন দেহরক্ষী পানিতে ঝাঁপ দিল। এই সময়টায় স্রোতের গতি বেশি হয়। তারা ছুটল মানুষটার দিকে প্রচন্ড ক্ষিপ্ততায়। অবশেষে মানুষটাকে নদীর পানি থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো।
রাজকুমারীর সামনে মানুষটাকে শুয়ে দেওয়া হল। মানুষটার দুই হাত বাঁধা।
রাজকুমারী বলল, ‘ওকে হাকিমের কাছে নিয়ে যাও। এখনই। আমার পালকীটা নিয়ে যাও। ঢেকে নিও। যেন কেউ বুঝতে না পারে। আর হাকিম সাহেবকে আমার সালাম দিবে। যাও।‘
দুইজন শক্ত দেহরক্ষী ছুটোল মৃত প্রায় মানুষটাকে নিয়ে।
[২}
২ দিন পর মানুষটা বেশ সুস্থ বোধ করছে। তাকে মেরেই ফেলেছিল। হাত বেঁধে পানিতে ফেলে দিয়েছিল। ভালো সাঁতার জানার পরেও স্রোতের টানে সে মরেই যাচ্ছিল। কেউ একজন তাকে বাঁচিয়েছে । তবে কেউ বলতে পারে না, সে কে!
আরো ২ দিন কাটল। তারপর হাকিমের কাছে বিদাই নিয়ে সে কড়া রোদে হেঁটে যেতে লাগল। তাকে যেতে হবে বহু উত্তরে। যদিও যাওয়াটা ঠিক হবে না।
এক অশ্বরহী তার পথ আটকালো। তারপর আরো তিনটি অশ্বরহী।
আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।‘ একজন বলল।
অশ্বরহীর গলার সুর রুক্ষ হলেও চড়া না। তারপর সম্মান দিয়েই কথা বলছে বলেই মনে হল। কিন্তু এদের সাথে যাওয়া কি ঠিক হবে। যদিও সে নিশ্চিত এখানে কেউ তাকে চিনে না।
আমাকে কোথায় যেতে হবে, আমি কি তা জানতে পারি?
না আপনাকে তা বলা যাচ্ছে না।
আমার জানতে ইচ্ছে করছে।
একজন নেমে এলো নীচে। বিষয়টা আমরা নিজেরাও জানি না।
একটা ঘোড়া দেওয়া হল। মানুষটা উঠে বসল তাতে। তিন বার ঘোড়া পরিবর্তন করা হল তিনটা আলাদা আলাদা ফাঁকা জায়গায়। বিষয়টা ভালো লাগছে না।
একটা জঙ্গলের কাছাকাছি আনা হল তাকে। নামতে বলা হল। সে নামল। অন্য তিন অশ্বরহীরাও নামল। তারপরই আচমকা তার মুখে একটা ঘুষি পড়ল। সে ভেবে পেল না কি ঘটছে।
নিজেকে সামিলে নিতে তার একটু সময় নিল। ততক্ষনে বেশ কিছু কিল ঘুষি খেয়ে নিতে হয়েছে তাকে। যখন সামলে নিল, তখন সে ল্যাঙটা মারল কাছের জনকে। তারপরেই সে উড়ে গেল দ্বিতীয় জনের দিকে। তৃতীয় জনও রক্ষা পেল না তার হাত থেকে। যতটা ঘুষি তাকে হজম করতে হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ ফিরত দিতে পারল ওদের। আর তখনই আরেকটা অশ্বরহী বিশাল এক তরবারি হাতে এগিয়ে এসে থামল। খুব শক্ত গলায় বলল, ‘থাম যুবক।‘
মানুষটা থামল।
[১]
নোমান প্রেম তোমাকে কোথায় নিয়ে গে্লো! প্রেমই যে আমাকে শিখালো এই জগতে নজরটাই বড়। মনজিলই সে, আমিও সে। এ এমন এক অন্ধকার যেখানে না নিজেকে দেখা যায়, না গোটা দুনিয়া। সারা জাহান যেমন অন্ধকারে ডুবে আছে , প্রেমও তেমন। সর্বত্রই সে আর সে। আমি যেটুকু পেয়েছি সেটুকুর জন্য শুকরিয়া। আর যেটুকু পাইনি সেটুকুর জন্যও।।
[২]
নোমান, পিছনের হিসাব দেখতে চেও না। থাক। থাক না ওসব। যা তুমি পাওনি, তা আল্লাহই তোমাকে দিয়েছেন। আর যা তুমি পেয়েছ, তাও আল্লাহই তোমাকে দিয়েছেন। তাই যা পাওনি তার জন্য আফসোস করো না। আর যা পেয়েছ তার জন্যও না।।
[৩]
দুয়ারে দুয়ারে যে পৌছে যেতে জানে না, তার নিজের যত গল্পই থাক, তা কখনো অন্যদের কাছে প্রকাশ হয় না। আর তুমি তাকে মাতালও বলতে পারো, নোমান। কেননা প্রত্যেক স্বাদ সৃষ্টিই হয় অনেকগুলো মসলা ব্যবহারের পরিমাপের গুনে।।
মোঃ নোমান সরকার
বড় মামা বলল, তুমি যদি ওয়াশরুমের কমোডের কভারটা নামিয়ে না রাখো, তাহলে কমোডের ভিতরের সব ব্যাকটেরিয়াগুলো উঠে আসবে। আর সারা ওয়াশরুমে ছোটাছুটি করবে। ওরা তোমার দাঁতের ব্রাশে এসে শুয়ে থাকবে। এয়্যা! কি বিছরি ব্যাপার। আর সেই ব্রাশ দিয়ে তুমি দাঁত মাজলে…..।” বলেই থামল বড় মামা।
এই কথায় ইরার কান্না পেয়ে গেল। সত্যি সত্যিই দুষ্ট ব্যাকটেরিয়াগুলো ওয়াশরুমে বাস করে? সাইন্স টিচার সেরকম কথা বলেছিলেন একদিন। কিন্তু তখন কেন তিনি বলেননি, কমোড ফ্লাস করেই কমোডের ঢাকনা নামিয়ে রাখতেই হবে। ছিঃ ছিঃ ব্যাকটেরিয়াগুলো এতই দুষ্ট…। আর সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো ব্রাশে এসে শুয়ে পরবে। আর সেই ব্রাশ দিয়ে দাঁত……। ইরার চোখে পানি এসে গেল।
বড় মামা এসেছেন কানাডা থেকে। ছোট মামার বাসায় আছেন তিনি। সেখান থেকে আজ সকালে ইরাদের বাসায় এসেছেন। সেই নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে ইরার মা বাবা ঘরের অনেক কিছু বদলে ফেলার কথা ঠিক করেছিল। যার কিছু কিছু ইরা শুনতে পেয়েছিল। এইসব নিয়ে তার আনন্দের সীমা ছিল না। গত রাতে মা আর বাবা বাসা সাজ্জাচ্ছিল। আর সকাল থেকে মা রান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। বাবা একটু পর বাইরের থেকে কি যেন আনেন। মামা এসে তো মহা বিরক্ত, দুইজনের একজনকেও পাচ্ছেন না। ইরা ছোট মানুষ। তার সাথে মামা কি আর কথা বলবে। আর সে কেন যেন বড় মামাকে দেখে ভয়ে সিটকে আছে। ইরা নিজেকেই বুঝতে পারছে না। বড় মামার গল্প এত শুনছে, ছবি দেখেছে, ভিডিওতে দেখেছে। তবুও ইরা মামার সাথে সহজ হতেই পারছে না। মামা পুতুল, খেলনা, চকলেট সহ কত কি দিয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তার ভয়ই কাটছে না।
বড় মামা বলল, ইরা তুমি কি তোমার ওয়াশরুমের কমোডের কভারটা নামিয়ে রেখে আসবে? আমি দেখেছি, সেটা খোলা আছে। নাকি আমি এই কাজে তোমাকে সাহায্য করব। বলেই বড় মামা উঠে দাঁড়াল। দাঁড়ালে মামাকে অদ্ভূত সুন্দর দেখায়। ছোট মামার ইয়া বড় ভুঁড়ি। আর বাবাও। কিন্তু বড় মামা এত বড়, অথচ উনার কোন ভূড়ি নেই। সিনেমার নায়কদের মতন। ইরার খুব ভাল লাগল।
বড় মামা হাত বাড়িয়ে বলল, এই যে পিন্স তুমি কি তোমার হাতটা দিবে?
ইরা বিস্মিত হল ঠিকই তবুও হাত এগিয়ে দিল। বড় মামা ইরার ছোট্ট হাত হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো।
ওয়াশরুমের কমোডের ঢাকনা খোলা। বড় মামা বলল, “ইরা কমোডের ঢাকনাটা বন্ধ করে এসো। প্রয়োজন ছাড়া এটা খুলবে না, ঠিক আছ? কমোডের ভিতরে অগনিত ব্যাকটেরিয়া বসবাস। খোলা পেলেই ওরা খেলতে নামবে। আর ওরা তোমার ব্রাশও দখলে নিবে।”
”হ্যা, মামা আমার মনে থাকবে। ঐ দুষ্টদের আমি কখনো সুযোগ দিব না।” বলতে বলতে ইরা নিজেই অবাক হল, বড় মামার সাথে সে সুন্দর করে কথা বলতে পারছে বলে।
বড় মামার হাত ধরে ইরা ফিরে এলো ড্রইং রুমে। তার এমন হল যে মনে হচ্ছে বড় মামা এ বাড়িতে থাকে। আর সে সব সময় গল্প করে, খুবই ভাব।
“বড় মামা আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
বড় মামা আনন্দিত গলায় বলল, “হাজার বার প্রশ্ন করতে পারো।”
ইরা বলল, “আমার আরবী টিচার যে আমাদের ওয়াশরুমে প্রবেশের আগে একটা দোয়া পড়া শিখিয়েছেন, সেটা কি এই ব্যাকটেরিয়াদের জন্য। এরা কি জিন?”
বড় মামা বলল, “না বাবা, এরা জিন না। এরা অতি ক্ষদ্র এক প্রানী। এ নিয়ে আমি তোমাকে অনেক অনেক গল্প বলব। এদের সমন্ধ আমাদের অনেক বেশী জানার আছে।”
ইর বলল,”টিচার বলেছেন, “ওয়াশরুমে কিছু দুষ্ট জিন থাকে, ওদের জন্য এ দোয়া পড়তে হয়।”
বড় মামা বলল, “ব্যাকটেরিয়াদের যেমন আমরা দেখতে পাই না, তেমনি ওয়াস রুমের দুষ্ট জিনদেরকে আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু ওরা ঠিকই আমাদের দেখতে পায়, যেমন ব্যাকটেরিয়াগুলো আমাদের দেখতে পায়। আমরা কমোডের ঢাকনা বন্ধ করে দিলে ওদের আর কিছুই করার থাকে না, আটকে ফেলি ওদের। তাই না? তেমনি দোয়াটা পরলেই আমরাও জিনদের কাছে অদৃশ্য হয়ে যাই। দোয়া পড়লে দুষ্ট জিনরাও আমাদের খুঁজে পায় না। আর তুমি বৃষ্টির দিনের কথা ভাবো তো। একটা ছাতা আমাদের কত বড় বন্ধু। তাই না? বৃষ্টির দিনে ছোট্ট একটা ছাতা যেমন করে আমাদের বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচায় ঠিক তেমনি এই দোয়াটা দুষ্ট জিন থেকে আমাদের বাঁচায়। এই দোয়াটাও আমাদের বন্ধুর মতন। এসো আমরা ওয়াস রুমের ব্যাকটেরিয়ারদের বিষয় ভালো করে জানি। জীবনের প্রয়োজনেই এই বিষয়গুলো জেনে রাখতে হবে।”
ইরা মাথা ঝুকালো। যেন সে কথা খুব বুঝেছে।
বড় মামা ঘরের ছাদের দিকে তাকালো। ইরা ও।
এবার বড় মামা ইরার দিকে তাকিয়ে বলল, “ফ্লাস করার সময় ব্যাকটেরিয়া কমোড থেকে বেশ উপরে উঠে আসে। উঠে আসতে পারলেই ওরা ছরিয়ে পরে ওয়াস রুমে। তাই ফ্লাস করার সময় কভার বন্ধ করে নিতেই হবে। বলে বড় মামা থামাল। থেমে জোর গলায় বলল, যেন ইরা শুনতেই পায়নি। “কভার ফেলেই ফ্লাস করতেই হবে, মনে থাকবে ইরা।”
ইরা লাফিয়ে উঠে বলল, “হ্যা মামা মনে থাকবে। ওদের দুষ্টুমি করতে দেওয়া যাবেই না।”
তখনই পিছন থেকে বাবা এসে বলল, “কিরে ইরা, মামার সাথে অনেক গল্প হচ্ছে। আয়, আমরা বারেন্দায় গিয়ে বসি। মিষ্টি রোদ আছে সেখানে।”
এক বনে বাস করত এক শিয়াল। সে সবাইকে নানান ভাবে কষ্ট দিত। আর সারাক্ষণ ভাবত কাকে কিভাবে ছোট করবে বা বিপদে ফেলবে। একদিন দুপুরে সে এসে পড়ল সিংহ রাজার বাড়ির কাছে। তার ইচ্ছে করল এবার বনের রাজাকে একটু ঝামেলায় ফেলার। এর আগে এমন সাহস করেনি। কিন্তু আজ হলো।
সে সিংহ রাজার বাড়ির কাছে এসে ডাকল। ‘রাজা মশাই বাড়িতে আছেন?’
সিংহ বের হতে হতে হুংকার দিয়ে উঠে বলল, ‘বিশ্রামের সময় কে ডাকে? এই অসময়ে কে ডাকে?’
শিয়াল খুবই বিনীত ভাবে বলল, ‘আমি শিয়াল। খুবই জরুরী বলে এই অসময়ে ডেকেছি।’
সিংহ শিয়ালকে দেখে খুবই বিরক্ত হল। শিয়ালের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ শুনেছে।
শিয়াল বলল, ‘বনের উত্তর দিকটা একটা ঘোড়ার বাবু হয়েছে।’
সিংহ গর্জে উঠে বলল, ‘সে কথা আমাকে জানাতে এই বিশ্রামের সময় কি তুমি ইচ্ছে করে বেছে নিয়েছ?’
শিয়াল বলল, ‘না রাজা। আমি জানাতে এসেছি সেই ঘোড়ার বাবুর পাঁচটি পা হয়েছে।’
সিংহ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
শিয়াল বলল, ‘বাবুটা জন্ম হবার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পরেছে। সম্ভবত বাঁচবে না। তাই ঘোড়া বলছিল, তার বাবুটাকে বনের রাজা সিংহকে দেখতে চায়। বাচ্চাটা মারা গেলে তার মাও আসলে বাঁচবে না। তার কথা শুনে এত খারাপ লাগল যে আপনার কাছে এসেছি এই অবেলায়।’
সিংহের মনে দয়া হল। সে বনের রাজা। তাকে দেখতে চেয়েছে। আর বাবুটা মরে যাচ্ছে। সে রাগি গলায় বলল, ‘আচ্ছা চল তবে।’
শিয়াল আর সিংহ রওনা হল। যেতে যেতে সিংহ্ ভাবছে অনেক কিছু। শিয়ালে বিরুদ্ধে অনেক অনেক অভিযোগ। শিয়াল একটা মিথ্যাবাদী। সে কারনে অকারনে মিথ্যা বলে আর সবার মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। এই দুষ্ট শিয়ালের কথা সে বের হয়ে আসল! খবরটা সত্য নাকি মিথ্যা যাচাই দরকার ছিল।
শিয়াল সিংহ নিয়ে ছুটছে তো ছুটছে। পথ আর শেষ হয় না। বিকাল ফুরিয়ে যাচ্ছে। এক সময় শিয়াল থামল এমন একটা জায়গায় যেখানে দুইটি পথের সূচনা। শিয়াল থামতেই সিংহও থামল। শিয়াল সামনের দুটি পথের একটি পথ দেখিয়ে বলল,’রাজা এই পথ দিয়ে গেলে সময় অনেক কম লাগবে। কিন্তু এই পথ দিয়ে যাওয়া হবে না। সমস্যা আছে। আমরা বরং আমরা ঐপথে ঘুরে যাই।’
সিংহ বলল,’ কেন এই পথে গেলে সমস্যা কি?’
শিয়াল বলল, ‘আপনি বনের রাজা সব কথা যেমন আপনার জানা উচিত ,তেমনি কিছু কথা না জানাও ভালো। চলুন আমরা ঐ পথে যাই।’
সিংহ রাগী গলায় বলল,’ ‘আগে আমাকে জানাও কেন যাব না। সেটি আগে বল।’
‘রাজা সব শুনতে না চাওয়াটা ভালো।’
সিংহ হুংকার দিল।
শিয়াল ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘এই পথে এক বিশাল হাতি এসেছে পাশের বন থেকে। সে বলে কিনা, আমি হব এই বনের রাজা। সিংহকে পেলে ওকে এমন আছার দিব। সে মরেই যাবে। তখন আমি হব এই বনের রাজা। পাগলের মতন যাকে পাচ্ছে, তাকেই সে এমন কথাগুলো শুনাচ্ছে।’
সিংহ আরেকটা হুংকার দিল,’ কি এই কথা বলেছে!’
শিয়াল বলল,’রাজা মশাই,আমি এই জন্যই এই কথা বলতেই চাইনি, আরে পাগলে এমন অনেক কথাই বলে বেড়ায়। থাক রাজা, আমরা এই পথ বাদ দেই। চলুন ঘোড়ার বাবুকে আগে দেখে আসি।’
সিংহ বলল, ‘না চল আমার সাথে। আমি তোমার সেই বিশাল হাতি আর তার ক্ষমতা দেখব। এত বড় সাহস আমার বনে এসে বনের রাজা হতে চায়।’
দুইজনই ছুটল। তারপর শিয়াল একটা সরু খাল পাড়ের কাছাকাছি এসে থামল। থেমেই শিয়াল সিংহকে দূরে বিশাল হাতিটাকে দেখিয়ে বলল, রাজা মশাই ঐ যে দূরে বিশাল হাতিটা ঘাস খাচ্ছে, সে আজ সকালে এখানে যাকে পেয়েছে বলেছে ,তাকে যেন সবাই রাজা মানে। এখন থেকে সেই বনের রাজা।’
সিংহ একটা হুংকার দিয়ে প্রচন্ড বেগে ছুটে গেল বিশাল হাতিটার দিকে। গিয়ে হাতির পিঠে উঠল এক লাফে। তারপর বড় একটা কামড় বসিয়ে দিল।
হাতিটা মনেরা আনন্দে ঘাস খাচ্ছিল। হঠাত এমন ঘটনায় চমকে উঠেছে। সিংহ যখন পিছন থেকে পিঠে উঠে কামড় বসাল। তখন প্রচন্ড ব্যাথায় সে কাকিয়ে উঠে শুর দিয়ে সিংহকে ধরার চেষ্টা করতেই পেয়েও গেল। আর পেছিয়েই ছুড়ে ফেলে দিল সিংহটাকে। সিংহ উড়ে গিয়ে অনেক দূরে একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে ধপাস করে পড়ল।
সিংহ গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে ধপাস করে পড়তেই হাতি দৌড়ে তার কাছে গিয়ে আবাক বিস্ময়ে বলল, আমি লজ্জিত রাজা, আমি বুঝতে পারিনি, আমার পিছনে আপনি! আমি খুবই দুঃখিত আমার আচরণের জন্য।’
সিংহ হাতির ব্যবহারে বুঝতে পারল শিয়াল তাকে বোকা বানিয়েছে।
সিংহ তবুও জানতে চাইল, তুমি নাকি নিজেকে রাজা বলে দাবি করেছ?’
হাতি বলল, আমি? আমি কেন এই কাজ করতে যাব? আমার বনে আগুন লাগায় খাবার কমে গেছে বলে এই বনে খাবারের খোঁজে এসেছিলাম। সকালে শিয়ালের সাথে দেখা। সে বলল, বনের রাজার অনুমতি না নিয়ে যারা এই বনের বাইরে থেকে এসে খাবার খাবে তাদেরকে মেরে ফেলতে বলেছে রাজা। কিন্তু আমি এতই ক্ষুধার্ত রাজা যে আপনার অনুমতি নিতে যেতে পারিনি। এখন আমি এই বনের অনেক খাবার খেয়েছি, তাজা ঘাস খেয়ে ফেলেছি ক্ষুধায়। আমি অপরাধ করেছি, এখন আপনি যে শাস্তি দিবেন, তাই মেনে নিব।’
সিংহ বলল, আমি বনের রাজা, আমি তোমাকে বলছি, এমন কোন আইন নেই আমার। এমন মিথ্যা আইনের কথা শিয়াল তোমাকে বলেছে? হুম ,আর আমাকে তোমার কথা কি বলেছে জানো? বলেছে, তুমি বনের রাজা হতে চাও। ওকে বড় একটা শাস্তি দেওয়া উচিত।’
হাতি বলল, ‘আপনি অনুমতি দেন, ওকে আমি ভর্তা বানিয়ে দেই।’
সিংহ বলল, এসো, আমি তোমাকে এই বিষয়ে কিছু সাহায্য করি। বলে দুইজনই ছুটল শিয়ালের দিকে।
এদিকে শিয়াল দূর থেকে ওদের কথা বলা থেকেই নিজের বিপদের কথা বুঝতে পেরেছিল। সে দৌড়াতে শুরু করল। কাছেই একটা খাল থাকায় সে সিংহ আর হাতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারল। বিপদের কথা আগে থেকে মাথায় রেখেই সে খাল পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
আর সেই থেকে শিয়াল সিংহ আর হাতিদের এড়িয়ে চলে।
মোঃ নোমান সরকার
সিংহের বাড়ির কাছে এসে শিয়াল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চারদিক ভালো করে দেখল। তারপর আরো সামনে এগিয়ে গিয়ে সিংহকে ডাকল। ‘রাজা মশাই, রাজা মশাই বাড়িতে আছেন?’
সিংহ বের হয়ে এসে খুব মন খারাপ করে বলল, ‘সিংহী মারা গেল। বনের সবাই আসেছিল। একমাত্র তুমি আসনি। একমাত্র তোমাকে দেখতে পাইনি। শিয়াল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’ঐ পাহাড়ের পিছনের বনে গিয়েছিলাম। আজ বনে এসে জানতে পেয়েই দৌড়ে এসেছি। বনের রাণী নেই। বনের রাজাকে কিছু বলার ভাষা নেই। তবুও একটা কথা বলতে চাই। সাহস পাচ্ছি না। যদি সাহস দেন তবে বলি।’
সিংহ খুব শান্ত গলায় বলল, ‘তুমি বলো।’
শিয়াল ধীর গলায় বলল, ‘আপনি কি সম্রাট শাজাহানের নাম শুনেছেন?’
সিংহ বলল, ‘না। আমি সারাদিন আমার প্রজাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তুমি পন্ডিত, বই পড়া নিয়েই থাক। তুমি আমার চেয়ে ভাল জানো।’ শিয়াল মৃদু হাসল। তারপর হাসিটা গোপন করে বলল, ‘সম্রাট শাজাহান হলেন মানুষের মধ্যে এমন একজন রাজা যিনি নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাজমহল বানিয়েছেন। শিয়াল তাজমহলের একটা ছবি বের করে দেখাল। সম্রাট শাজাহান, মমতাজ বেগম আর তাজমহল নিয়ে অনেক অনেক কথা হল।
সিংহ সব শুনে মুদ্ধ হল। সম্রাট শাজাহানের প্রতি তার শ্রদ্ধা প্রতি মুহূর্তেই বাড়তে লাগল। তা বুঝতে পেরে শিয়াল গম্ভীর গলায় তাজমহলের আরো গল্প বলতে লাগল,বলতেই লাগল। সিংহের মনে হতে লাগল সে তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে শিয়াল।
এক সময় সিংহ বলল, ‘তুমি বলছ, আমিও একটা তাজমহল বানাই?’
শিয়াল বলল, ‘মমতাজ থেকে তাজমহল। আর আমরা চাই, সিংহীমহল।’
পরের দিন সাড়া বনে জানিয়ে দেওয়া হল, সিংহীমহল হবে। তাই যার যা আছে তা রাজকোষে জমা দিতে। বনের সব প্রানী অবাক হয়ে সব শুনল সিংহীমহলের কথা। তারা কিছুই বুঝল না, প্রশ্নও করল না, মুখে কিছু বলল না। রাজার আদেশ বলে কথা। বনের যার কাছে যা ছিল, সব দিল। আর সব জমা হতে লাগল রাজকোষে। শিয়াল বনের রাজাকে বোঝাল দিনে সে ব্যস্ত থাকবে সিংহীমহল বানাতে। আর রাতেই হিসাব নিকাশ করবে। তাই রাজকোষের সাথেই শিয়াল তার অর্থভাণ্ডার গড়ে তুলল। রাতের আঁধারে রাজকোষ থেকে তা চলে যায় শিয়ালের ভান্ডারে।
সপ্তাহ যেতে না যেতে আবার হুকুম আসল বনের রাজা থেকে যে, প্রতি মাসেই কর দিতে হবে, যার কাছে যা আছে সব দিতে হবে। বনের প্রাণীরা ভয়ে ভয়ে তাই করতে লাগল।
এভাবেই দিন যায়,মাস যায়, বছর যায়। প্রতি মাসে প্রজাদের সঞ্চয়ে যা আসে তা রাজকোষে জমা দিতে হয়। তারপরেই তা চলে যায় শিয়ালের ভান্ডারে। কেউ টু শব্দ করার সাহস পায় না।
এদিকে সিংহীমহলের কাজ আর শেষ হয় না। শিয়াল বলেছিল তাজমহল বানাতে লেগেছে ২০ বছর। আধুনিক টেকনোলজির কারনে আমাদের লাগবে এক বছর বা তার চেয়েও কম সময় লাগতে পারে। অথচ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে।
সিংহ অস্থির হল। শিয়াল শুরুতে তাকে বলেছিল, এক বছর সময় লাগবে। এখন বলছে দুই বছর! সিংহ প্রচন্ড বিরক্ত হলো, রেগে গেল। প্রজাদের কষ্ট আর সহ্য হচ্ছে না। প্রজারা কেবল দিয়েই যাচ্ছে। আর সব জমা হচ্ছে শিয়ালের ভান্ডারে। এ নিয়ে সিংহ কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। একদিন সিংহং গেল সিংহীমহল দেখতে। শিয়াল সিংহকে নিয়ে গেল বিশাল এক পুকুরের কাছে।
সিংহ বনের সব প্রাণীরা সাথে নিয়ে গিয়েছিল। বনের সব প্রাণীরাদের ডাকতেই তারা চলে এলো পুকুরের কাছে। তারপর তারা পুকুর ঘিরে দাঁড়াল।
শিয়াল বলল, ‘পুকুরের নীচ থেকে উঠানো হচ্ছে সিংহীমহল। আর পুকুরের নীচ থেকে উঠে আসতে লাগবে আরো এক বছর।’
সিংহ বলল, ‘তুমি বলেছিলে এক বছর বা তার চেয়ে কম সময়ে হয়ে যাবে।’
শিয়াল বলল, ‘বলা আর করার মধ্যে অনেক পার্থক্য, রাজা হিসাবে সেটা আপনি আমার চেয়েও ভাল বুঝেন।’
সিংহের মন খারাপ হল। প্রজাদের কথা ভাবল। প্রজাদের সন্তানরা আর কতদিন ঠিক মত খাবার পাবে না, সে কথা ভাবতেই সিংহ বলল,’আপাতত কাজ বন্ধ রাখো। কয়েক বছর যাক, তারপর আবার শুরু করা যাবে।’
শিয়াল হেসে বলল, ‘রাজার যা ইচ্ছা তাই হবে। তবে কাজ কতটুকু হয়েছে তা দেখবেন নিজ চোখে।’
সিংহ গম্ভীর গলায় বলল, তুমি জানো যে আমি সাঁতার জানি না।’
শিয়াল বলল, ‘আমিও তো যাচ্ছি আপনার সাথে। আমাকে বিশ্বাস করুন, আমার সাথে আসুন। যে পুকুরটা দেখছেন এর মধ্যখানে কোন পানি নেই। দেখবার মতন একটা জায়গা বটে। সেই জায়গাটায় তৈরি হচ্ছে সিংহীমহল। সব শ্রমিক পানির নীচে কাজ করছে। অথচ ওদের শরীরে পানি স্পর্শ করছে না। টেকনল্যাজি আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে! আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন।’
শিয়াল বিশাল একটা গাছ পানিতে আগেই ফেলে রেখেছিল। হাতিগুলো দিয়ে বড় একটা গাছ পানিতে ফেলে রেখেছিল।
শিয়াল বলল,’ চলুন আমরা এগিয়ে যাই।’
সিংহ অবিশ্বাস নিয়ে শিয়ালের দিকে তাকাতেই শিয়াল বলল, ‘এই পড়ে থাকা গাছের শেষ পান্তে গেলেই দেখবেন তাজমহলের চেয়েও আরো বেশি সুন্দর হচ্ছে সিংহমহল। দূর থেকে দেখে মনে হবে, পানির নীচে থেকে এই সুন্দর একটা ভবন উঠছে। আর আমি তো আপনাকে বলেছি পুকুরের মধ্য অংশে ওখানে কোন পানি নেই।’ এই কথা বলে শিয়াল আবার তাজমহলের ছবিটা দেখিয়ে বলল, এর চেয়েও অনেক অনেক সুন্দর হবে আমাদের সিংহীমহল।’
সিংহ মুগ্ধ চোখে তাজমহলের ছবিটার দিকে তাকাল। প্রচন্ড আনন্দ তাকে অস্থির করে তুলেছে। মনের আনন্দে পানিতে শুয়ে থাকা গাছটার উপর হেঁটে এগিয়ে গেল। পিছনে শিয়াল। সিংহের মনে হল না, সে সাঁতার জানে না।
শিয়াল সিংহের কাছে এসে বলল, ‘আমরা এমন একটা বিল্ডিং বানাতে যাচ্ছি যা দেখতে মানুষও আসবে। আপনি ভয় পাবেন না। আমার প্রতি বিশ্বাস রাখুন।’
সিংহ আর শিয়াল আরো এগিয়ে যেতেই শিয়াল বলল, আমরা প্রায় চলে এসেছি। আর একটু এগিয়ে গেলেই গাছটা দুলতে থাকবে। আর আস্তে আস্তে নীচে নামতে থাকবে। তখন আপনার মনে হবে আপনি পড়ে যাচ্ছেন। টেকনল্যাজির কি চমক। প্রজারা দেখছে আমাদের, তাই সাহসী রাজা আপনি ভয় পাবেন না। চিৎকার করে লজ্জায় পড়বেন না। ‘
আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে শিয়াল বলল,’এই সিংহীমহলের নীচের অংশের অপূর্ব কারুকাজ আপনি একা একা দেখবেন? আমার মনে হয় সেই ভাল হবে। দেখবেন আর আর মুদ্ধ হতে থাকবেন। সেটাই ভাল হবে।’ বলেই তাজমহলের ছবিটা আবার দেখাল সিংহকে।
সিংহ মুদ্ধ চোখে তাজমহল দেখল আবার। সে যে পানির উপরে একটা ভাসমান গাছের উপর দাঁড়িয়ে সেটা ভুলে যাচ্ছে বারবার।
শিয়াল মহা আনন্দের সাথে বলল,’ আপনার দেখা শেষ হতেই আমাকে ডাকবেন। আমি আপনাকে আবার নিয়ে ফিরে আসব। ‘ এই কথা বলে ধীর পায়ে শিয়াল গাছের ডাল থেকে সরে এলো। ফিরে এল পুকুরের পাড়ে।
কি ঘটছে জানতে প্রাণীরা শিয়ালকে ঘিরে ধরল। শিয়াল ঘাড় ঘুরিয়ে সিংহকে দেখল। সিংহ এখন অনেক দূরে তাকে শুনতে পারবে না। শিয়াল উঁচু গলায় বলল সব প্রাণীদের উদ্দেশে, সিংহীমহল তৈরি হয়ে গেছে পানির নীচে। আমাদের রাজা যাচ্ছে সিংহীমহলে। সেখানেই রাজা থাকবেন। রাজা ফিরবেন এক যুগ পরে। এই এক যুগে তোমাদের আর কর দিতে হবে না। তিনি ফিরে এলে আবার কর নিতে শুরু করবেন। সেই কথা তিনি আমাকে বলে গেছেন।’ শিয়াল দেখল এই কথা শুনতে পেয়ে সব প্রাণী আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারল, করের বোঝা থেকে মুক্তি পেয়ে তারা যেন নিজেদের মুক্ত মনে করছে।
শিয়াল বলল, এই পুকুরের মধ্যখানেই সিংহী মহল আর ওখানে পানি নেই। তোমরা এখন গাছটাকে ঝাঁকাতে শুরু করতেই সিংহ লাফিয়ে নামতে পারবে ওখানে।’
শিয়ালের এই কথা শেষ হতেই সব প্রাণীরা এক যোগে ঝাঁকাতে লাগল পানিতে পড়ে থাকা গাছটা। আর এতেই সিংহ পানিতে পরে গেল।
সিংহীমহল দেখবার নেশায় ডুবে ছিল সিংহ। তাই সে প্রথমে গাছের ঢালের ঝাঁকুনিতে ভয় পায়নি। কিন্তু যখন ঝাঁকি প্রবল হয়ে পানিতে পরে যেতে যেতে সে বিস্মিত হল। টেকনোলজি কিছু নয়, সে তাকিয়ে দেখল তার প্রজারাই গাছের ডাল ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে। যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না বিষয়টি! সে পানিতে পরতেই সবকিছু পরিস্কার বুঝে গেল।
শিয়ালের প্রলোভন দেখানো প্রতিটি কথা তার মনে হল। মনে হল, শিয়ালের কথা শুনে সে সরল ভাবে বিশ্বাস করেছিল। আজ তার পরিনতি ভোগ করতে হচ্ছে। কাউকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করতে নেই। শিয়াল যেভাবে তাকে বোকা বানিয়েছে তেমনি প্রজাদের বোকা বানিয়েছে বলে তারা সবাই মিলে গাছের ঢাল ঝাঁকাচ্ছে। নিজের ভাগ্যের পরিনতি দেখে তার নিজের জন্য দুঃখ হল। দুঃখ হল তার উচ্চাকংখার জন্য প্রজাদের প্রচন্ড কষ্টের কথা ভেবে। চট করে কারো কথায় বিশ্বাসের পরিনতি আর যথেষ্ট অনুসন্ধান না করে সরল ভাবে বিশ্বাস করাটা যে অনেক ভুল আর এত নির্মমই হয়, আজ এই বাস্তবতা বুঝতে পারল। কিন্তু কোন বড় ভুলের দ্বিতীয় সুযোগ হয় না। ইয়া কঠিন পরিনতিই হয়। তাই ভেবে যারা কাজ করে তাদের চট করে কেউ ঠকাতে পারে না।
সিংহ ডুবে যেতে যেতে প্রজাদের প্রতি করের জুলুমের কথা ভেবে চুপ করে রইল। যে বুঝে গেল শিয়াল তাকে হত্যা করতেই এখানে নিয়ে এসেছে। এখন যতই চেঁচাক, কাজ হবে না। এত দূর থেকে কেউ তাকে শুনতে পারবে না। তাই সে চারদিকে তাকিয়ে চিৎকার করল না। সে তাকিয়ে কেবল দেখে নিল তার দুখী প্রজাদের। সাঁতার না জানায় একটু পরেই পানিতেই ডুবে মরে গেল সিংহ।
সিংহ ডুবে যেতেই শিয়াল সবাইকে ডেকে বলল, ‘সিংহ সিংহীমহলের ভিতরে চলে গেছে। এই পুকুরের মধ্যখানে কোন পানি নেই, সেখানেই সিংহীমহলটা।’
পুকুরের চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনের কেউ বিশ্বাস করল , আবার কেউ করল না। কিন্তু প্রতি মাসে করের বোঝা থেকে এক যুগের জন্য মুক্তি পেয়েছে বলে সবাই খুশিতে নাচতে লাগল। নাচতেই লাগল।
শিয়াল তখন খুব জোরে বলল, ‘সিংহ যাবার আগে এক যুগের জন্য আমাকে রাজ্য পরিচয়ালনার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। তোমাদের কি কোন আপত্তি আছে?’
সিংহের অত্যাচার থেকে এক যুগের জন্য মুক্তি পেয়ে সবাই এক সাথে বলে উঠল’ আমাদের কোন আপত্তি নেই। তুমি যদি এক যুগের বেশিও থাক, তাতেও আমাদের আপত্তি নেই।’
সেই থেকে সেই বনের রাজা শিয়াল।
[ সায়ীদ আব্দুল্লাহ। আমাদের প্রিয় সায়ীদ ভাই। উনার ভায়ের দুই ছেলে, মাহিন ও রাইয়ান। তিনি শখ করে রান্না করেন। খুব মজার মজার খাবার নিজে বানাতে পছন্দ করেন। তিনি বলতে গেলে শুরু থেকে আমাদের এই সাইটের সাথে আছেন। স্বপরিবারে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। এটি তিনি দ্বিতীয় বারের মত খাবারের রেসেপি শেয়ার করলেন আমাদের সাথে। আশা করি সবাই বানাবেন মজাদার এই স্পাইসি চিকেন গোজন্স। https://www.facebook.com/saeedmahdi.au]
স্পাইসি চিকেন গোজন্স
ইনগ্রেডিয়েন্টস:
চিকেন ব্রেস্ট ফিলেট ৩ টি
প্লেইন ফ্লাওয়ার ২কাপ
তেল ডোবা তেলে ফ্রাই করা যায় সে পরিমান
মরিচের গুড়ো ৩ টেবিল চামচ
হলুদ গুড়ো ১ চা চামচ
দাড়চিনি গুড়ো ১/৪ চা চামচ
গোল মরিচ গুড়ো ১ চা চামচ
লবন ২ টেবিল চামচ
অয়েস্টার সস ১ চা চামচ
আদা বাটা ১/৪ চা চামচ
রসুন বাটা ১/৪ চা চামচ
মিল্ক অথবা ইয়োগার্ট ১/২ কাপ
মেরিন্যাশন পদ্ধতি:
চিকেন ব্রেট ফিলেটগুলো পাতলা করে লম্বালম্বি স্লাইস করুন।
একটি বোলোর মধ্যে ১/২ কাপ মিল্ক অথবা ইয়োগার্ট, ১ টেবিল চামচ লবন, ১ টেবিল চামচ মরিচ গুড়ো, ১ চা চামচ অয়েস্টার সস, ১/৪ চা চামচ আদা বাটা, ১/৪ চা চামচ রসুন বাটা নিয়ে ভালোভাবে মিক্স করুন।
চিকেন স্লাইসগুলো বোলে নিয়ে হাত দিয়ে ভালোভাবে লাগিয়ে ঢেকে ঘরের তাপমাত্রায় কমপক্ষে একঘন্টা রেখে দিন।
ফ্লাওয়ার কোটিং মিক্স: ২ কাপ প্লেন ফ্লাওয়ারের মধ্যে ২ টেবিল চামচ মরিচ গুড়ো (ঝাল কম খেতে চাইলে মরিচের গুড়ো নিজের স্বাদ মতো দিন), ১ চা চামচ হলুদ গুড়ো, ১/৪ চা চামচ দাড়চিনি গুড়ো, ১ চা চামচ গোল মরিচ গুড়ো, ১ টেবিল চামচ লবন দিয়ে ভালোভাবে মিক্স করে নিন।
চিকেন কোটিং: মেরিন্যাটেড চিকেনগুলো ফ্লাওয়ার কোটিং মিক্স দিয়ে ভালোভাবে কোটিং করে নিন। কোটিং করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো চিকেনগুলো হাতে উঠিয়ে কোটিং মিক্সের মধ্যে একবারে ভালোভাবে গড়িয়ে নিন। খেয়াল রাখবেন চিকেনগুলো যেনো ড্রাই কোটিং হয়।
ফ্রাইং পদ্ধতি: একটি ফ্রাইয়ারে অথবা একটি প্যানে পরিমান মতো তেল দিন। এমন পরিমান তেল দিন যাতে চিকেনগুলো লম্বালম্বি ডিপফ্রাই করা যায়। ১৪০ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় চিকেনগুলো ফ্রাই করুন। বাহিরের কালার যখন গোল্ডেন হয়ে উঠবে তখনই চিকেনগুলো কুক হয়ে যাবে। খেয়াল রাখুন যেনো চিকেন ফ্রাইগুলো কালচে রং ধারন না করে। ১৪০ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় মেক্সিমাম পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রতি ব্যাচ চিকেন কুক হয়ে যাবে।
কুক হয়ে গেলো স্পাইসি চিকেন গোজন্স। এবার ২-৩ মিনিট রেস্টিং-এর পর পরিবেশন করুন।
মোঃ নোমান সরকার
বিশাল বাড়িতে ফাইজা একা। মা নাস্তা খাইয়ে দিয়ে গেছে। ফ্রিজে রাখা আছে নানান খাবার। মা দেখিয়ে দিয়ে গেছে। যা খেতে চায় বের করে মাইক্রো ওভেনে গরম করে নিতে বলেছে। এ ছাড়াও নানান ধরনের খাবার তো আছেই। মা জানে ফাইজা পারবে। তবুও বারবার বলে গেছে সাবধানে সব করতে। এর আগে ফাইজাকে এভাবে একা রেখে যাওয়া হয়নি বলে মায়ের এত চিন্তা।
মা বাবা বাসার গেট থেকে বের হবার পরেও বারবার একই কথা বলে যায়,’ কোন সমস্যা হলেই যেন ফোন করে।’ যদিও বাবা খুব একটা কথা বলছিল না। ফাইজা তার লম্বা চুলগুলো দুই হাতে সরিয়ে মনে মনে বার বার বলে, আমার মা টা যেন কি! আচ্ছা আমি কি এত ছোট। আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। এতো ছোট্ট তো না।
বাবা ডাক্তার। আর মাও। সকালে দুইজন ফাইজাকে স্কুলে দিয়ে এক সাথে বের হয়ে যায় প্রতিদিন। আর স্কুলও বাসার একদমই কাছে। মিনির মা স্কুল থেকে নিয়ে আসে দুপুর হবার আগেই। মিনির মা এই বাড়িতে গৃহকর্মী। বয়স্ক আর অনেক পুরানো গৃহকর্মী বলে মিনির মায়ের উপর এই পরিবার ভরসা করে। দুপুরে খাওয়ার সময় মিনির মা বসে থাকে পাশে। ফাইজা বিশাল বাড়িতে মিনির মায়ের কাছে থাকে রাত পর্যন্ত। বাবা মা দুইজন ফিরে এলে সে বাসায় যায়। এই দীর্ঘ সময় ফাইজা না ঘুমালে মিনির মা গল্প করে, খেলে। আর ভিডিও গেইম মিনি মা খুব ভালো বুঝে। কিন্তু গতকাল থেকে মিনির মায়ের অসুখ। বিছানা থেকে উঠতেই পারছে না। যাবার পথে মা তাকে দেখে যাবে বলে গেছেন। এই প্রথম মিনির মা এ বাড়িতে এলো না। আর আজ স্কুলও নেই। মা যাবার আগে অনেকখন হাত ধরে বসে রইল। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিল বার কয়েক কিন্তু মুখে কিছুই বলল না।
গাড়িতে সম্ভবত উঠেনি, মা ফোন দিয়েছে। গাড়িতে উঠেও। তারপর আরো চার বার। হাসপাতালে ঢুকার আগেও। প্রতিবারই মা বলে যাচ্ছে সে এখন কোথায়। আর কত সময় পরে আসবে। কোন চিন্তাই যেন না করে। বাবা ফোন দেয়নি একবারও। তবুও পাশে থেকে বাবা এটা ওটা বলতে হবে তা মাকে শিখিয়ে দিচ্ছিল সে কথা শুনেছে প্রতিবারই ফাইজা।
ফাইজা এই ঘর সেই ঘর করছে। এত দিনের চেনা জানা এই বাসাটাকে আজ তার আরো বিশাল বলে মনে হচ্ছে। আগে কখনো এমন মনে হয়নি। তার মানে কি? কাছের মানুষরা থাকলে বাকী দৃশ্যগুলো আমাদের কাছে বড় মনে হয় না? কেউ নেই, আর এতে মনে হচ্ছে বাসাটা যেন একটা বড় মাঠ।
আর সময় যেন নড়ছে না। কিন্তু কার্টুন বা অন্য কোন প্রোগামও দেখতে ইচ্ছে করছে না টিভি বা কম্পিউটারে বা গেইম খেলতেও ইচ্ছে করছে না। হোমওয়ার্ক নিয়ে বসলেও হয়। তাও ইচ্ছে করছে না। যেটি ইচ্ছে করছে সেটি সম্ভব না। ইচ্ছে করছে বাইরে যেতে। বাসা থেকে দেখা যায় আইসক্রীমের দোকান, ওখানে গিয়ে আইসক্রীম কিনে খেতে।
ফাইজা জানালার কাছে এলো। তারা পাঁচ তালায় থাকে। সামনের বাম দিকে ছোট একটা মাঠ। তাই এই জানালা দিয়ে আকাশটা ভালো করে দেখা যায়। কত বড় আকাশ! আকাশ এত বড় কেন? কি আছে আকাশের ওপারে? মেঘের সাথে উড়ে যেতে পারলে কেমন হত? আকাশে পাখি নেই। নেই কেন? একটা পাখিও আকাশে উড়ে যাচ্ছে না। তাদের কি অসুখ করেছে? নানান ভাবনায় ফাইজা ডুবে গেল।
ফাইজার মিনির মায়ের কথা মনে পরল। মিনি মা একসাথে অনেক কথা বলে। কথা বলতে থাকে। আর সে নানান ধরনের গল্পও জানে। ফাইজার বয়সের এই শহরে অন্য কোন ছেলে মেয়ে এতগুলো মাছের নাম জানে না, গাছের নাম জানে না, নদীর নাম জানে না, এটা সে বলতে পারে, বলতে পারে মিনির মায়ের কারনে। সে প্রতিটা গাছ, গাছের পাতা, মাছ, লতাপাতা, নদী, বিলের নামে গল্প বলতে পারে। গল্প শুনতে শুনতেই মুখস্ত হয়ে গেছে সব। ফাইজা স্কুলে গিয়ে সে সব চেক করে দেখেছে। কেউ এই সবের অর্ধেক নাম জানেন না বা জানেই না অনেকেই।
মিনির মা এতখন থাকলে সময়টা কিভাবে কেটে যায়, বুঝাই যেত না। দুপুরে ঘুমের আগে হোম ওয়ার্ক করে তখন মিনির মা একেবারে চুপ। জানালা দিয়ে আকাশ দেখে। এত আকাশ দেখতে পারে মিনির মা। এমনটা সে আর কাউকে দেখেনি। আকাশে কি আছে, এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেও ভালো একটা উত্তর খুঁজে পায়নি ফাইজা। পড়ার ফাঁকে তবুও সে দেখেছে, কেমন উদাস চোখে মিনির মা আকাশ দেখছে। যেন ওখানে তাদের বাড়ি।
ফাইজা জানালা থেকে সরে এলো। তারপর আবার এই ঘর সেই ঘর করতে লাগল। সারা বাড়ি কেমন বড় বড় লাগছে। বাসাটা যেন একটু উঁচুতেও উঠে গেছে! খুব সামান্য হলেও উঁচু হয়ে গেছে বলে মনে হল। যেন ঘরগুলো হঠাত করে বড় হয়ে গেছে বা কেউ টেনে বড় করে দিয়েছে।
ফাইজা ওর লম্বা চুলে হাত দিয়ে ঠিক করল। তখনই আয়নার কাছে যেতে চাইল। তার নিজেকে কেন যেন দেখতে ইচ্ছে করছে। সেদিকে পা বাড়াতেই ঠিক করল গেইম খেলবে। কিন্তু মোবাইল হাতে নিতেই আর ইচ্ছে করল না। সে হাঁটছে আপন মনে। হ্যা, টিভি দেখা যেতে পারে। রিমোট হাতে নিতেই মনে হল সোফার পাশ দিয়ে কেউ দৌড়ে গেল। ছোট একটা ছেলে কি? নাকি ছোট একটা মেয়ে? নাকি অন্য কিছু! কিন্তু তা কি করে সম্ভব!
ফাইজা কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। সে ধীর পায়ে সোফার পিছনের দিকে উঁকি দিতে গেল। সে অতি ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বারেন্দার আলোটা সোফার গায়ে পড়ার আগেই থেমে গেছে। খানিকটা আলোহীন পরিবেশ। ফাইজা কেন যেন মনে হল ওখানে কেউ আছে। কেউ টা কে! কি!
ফাইজা এগিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে হাঁটতে পারছে না। পা টা কেমন যেন জমে গেছে। নিজেকে টেনেই নিয়ে যাচ্ছে।
[চলবে]
[ সায়ীদ আব্দুল্লাহ। আমাদের প্রিয় সায়ীদ ভাই। উনি ভায়ের দুই ছেলে, মাহিন ও রাইয়ান। তিনি শখ করে রান্না করেন। খুব মজার মজার খাবার নিজে বানাতে পছন্দ করেন। তিনি বলতে গেলে শুরু থেকে আমাদের এই সাইটের সাথে আছেন। স্বপরিবারে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। এটি তিনি প্রথম খাবারের রেসেপি শেয়ার করলেন আমাদের সাথে। আশা করি সবাই বানাবেন মজাদার এই কেক। https://www.facebook.com/saeedmahdi.au]
বাটার কেক
ইনগ্রেডিয়েন্টস:
১। সেল্ফরাইজিং ফ্লাওয়ার দেড় কাপ [সেল্ফ রাইজিং ফ্লাওয়ারের তৈরি করতে ১ কাপ প্লেইন ফ্লাওয়ারের সাথে ২ চা চামচ বেকিং পাউডার ভালোভাবে মিশিয়ে নিলেই সেল্ফ রাইজিং ফ্লাওয়ার হয়ে যায়]
২। ডিম দুইটা
৩। মেল্টেড বাটার এক কাপ
৪। চিনি এক কাপ
৫। লবন ১/৪ চা চামচ
৬। মিল্ক ১/২ কাপ
৭। ফ্ল্যাভার পছন্দ মতো (দাড়চিনির গুড়া ১/৪ চা চামচ)
৮। ড্রাই ফ্রুট অথবা পছন্দমতো যে কোন বাদাম
প্রিপারেশন:
লো ফ্লেইমে মিল্কটাকে হাল্কা গরম করে নিতে হবে। তারপর ঐ হাল্কা গরম মিল্কের মধ্যে এক কাপ চিনি ও লবন গলিয়ে নিন। মিশ্রনটি ঠান্ডা হলে দুটি ডিম ভালো করে মিক্স করে নিন। এরপর সেল্ফরাইজিং ফ্লাওয়ারগুলো মিশ্রনটির মধ্যে দিয়ে খুব ভালো করে মিক্স করুন। এবার গলানো বাটার ও এ্যাসেন্স এ্যাড করে ভালো করে মিক্স করে নিন।
বেকিং:
এবার বেকিং প্যানের মধ্যে বেকিং পেপার মুড়িয়ে বাটার ব্রাস করে নিয়ে মিশ্রনটি ঢেলে দিন। এবার মিশ্রনটির মধ্যে এক চা চামচ ফ্লাওয়ার দিয়ে ড্রাই ফ্রুট কিংবা বাদামগুলো মিক্স করে প্যানের মধ্যে মিশ্রনটির উপরে সুন্দর করে সাজিয়ে দিন। বেকিং টাইম: ১৪০ ডিগ্রী সে. প্রিহিটেড আভেনে কেক মিক্সটি দিয়ে ৫০ মিনিট বেক করুন। প্রয়োজনে সময় কমবেশী লাগতে পারে (বেকিং-এর মাঝখানে আভেন ডোর খোলা যাবে না। বেকিংএর মাঝখানে আভেন ডোর খুললে কেক রাইজিং বাধাগ্রস্থ হয়)। ৫০ মিনিট পর কেকটি নামিয়ে ঠান্ডা করে স্লাইস করে পরিবেশন করুন।
মোঃ নোমান সরকার
রাইয়ান তুমি কি ঘুমাচ্ছ?’ মিউ বিড়ালটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে খাটের নীচ থেকে বের হয়ে খুবই উত্তেজিত গলায় জানতে চাইল।
দুপুর বেলা। স্কুল থেকে এসে খাওয়া দাওয়া করে রাইয়ান বিছানায় শুয়ে ছিল ঠিকই কিন্তু তার চোখ খোলা ছিল। কিন্তু মিউ বিড়ালের কথায় চোখ বন্ধ করে বিরক্ত গলায় বলল, ‘তুমি না আড়ি নিয়েছ? আবার কেন এসেছে? আবার কথাও বলছ আমার সাথে?’
মিউ বিড়াল জোরে জোরে বলল,’ বাসায় ডাকাত এসেছে। আমি নীচে ওদের কথা বলতে শুনেছি।‘
রাইয়ান আড়ির কথা ভুলে গেল। লাফিয়ে মিউ বিড়ালের গলার শব্দটা যেদিক থেকে এসেছিল তা খুঁজে বের করে বলল, ‘সত্যি?’
রাইয়ান ভাবছে, মিউ বিড়াল খাটের নীচেই পালিয়ে ছিল! আবার আড়িও নেয়। ওকে কিছু একটা বলতে পারলে খুব ভালো লাগত। কিছু বলতে গিয়ে রাইয়ান থামল।
মিউ বিড়াল বলল,’ আমি সত্যি বলছি। আমি সব নিজ কানে শুনেছি ওদের সব কথা। ওরা বলছিল, বেল টিপ দিব প্রত্যেক ফ্লাটে। বেলের শব্দে অনেকেই হুট করে দরজা খুলে দেয় সেই সব ফ্লাটে ঢুকে যাব আমরা।’
রাইয়ান বলল,’আগে বলো, ডাকাত দেখতে কেমন? ইয়া বড় শিং আছে? দৈত্যের মতন দেখতে? এক দাঁত আছে ওদের কেবল? মাথাটা মতা? বিকট চেহারা?’
মি বিড়াল বলল, ডাকাতেরা তা হতে ্যাবে কেন! ওরা মানুষের মতনই। তবে ওরা দুষ্ট মানুষ।
মিউ বিড়াল বলল,’ ওরা বলছিল,বাসায় কেউ এলে দরজায় কড়া নাড়লে বা কলিং বেল টিপলে অনেকেই না জিজ্ঞাস করে, দরজার আই ভিউ এর ফুটো দিয়ে না দেখেই দরজা হুট করে খুলে দেয়। আমরা সেই সব বাসায় ঢুকে ডাকাতি করব। যারা হুট করে দরজা খুলে না। তারা হচ্ছে অতি বুদ্ধিমান। ওদের নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। যারা হুট করে দরজা খুলে আমরা তাদের কাছেই যেতে চাই। এই বলে ওরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিল।’
রাইয়ান বলল,’আমিও তো তা করি। হুট করে দরজা খুলে দেই। মা তাই করে, বাবা করে, বুয়া করে।
মিউ বিড়াল বলল,’হায়! আজ জানলাম, এভাবেই তো তাহলে সর্বনাশ করে ওরা! আর আমি যাদের কথা শুনেছি ওদের মনে হচ্ছে বড্ড দুষ্ট। বুঝতে পার ওরা বাসায় ঢুকে যেতে পারলে কি হবে?‘
রাইয়ান বলল,’ আরে আমি তো বেলের শব্দ শুনলে দৌড়ে এসে গেট খুলি। কখনোই প্রশ্ন করি না। এমনকি দরজার আই ভিউ এর ফুট দিয়ে দেখি না, কে এসেছে। কখনই দেখিনা। এমনটি আমি আর করব না। না বাবা না, আর করব না। মাকে করতে দিব না, বাবাকেও না, বুয়াকেও না। কিন্তু এখন কি হবে? আমি তো অনেক অনেক ভয় পাচ্ছি!’
মিউ বিড়াল বলল,’ ধুর বোকা ,তুমি এখনো তো দরজাই খুলোনি।‘
রাইয়ান ভয়ে ভয়ে, ‘হ্যা! হ্য! তাই তো!‘
তখন কেউ বেল দিল। রাইয়ান ভয়ে সেই শব্দে লাফিয়ে উঠল। সে দরজার আই ভিউ এর ফুটো দিয়ে দেখল কে এসেছে। সে দেখতে পেল তিন জন বড় মানুষ দাঁড়িয়ে। আর সত্যি সত্যি বিকট চেহারা সেই মানুষদের। ভয়ে রাইয়ান কাঁপতে লাগল।
মিউ বিড়াল বলল, ‘কাঁপছ কেন? তুমি তো এখনো দরজাই খুলনি। দরজা না খুললে ওরা তো ভিতরে ঢুকতে পারবে না। তোমার কোন ক্ষতিও তো করতে পারবে না। তোমার ভয় পাবার কোনই কারন নেই। তবে মনে রেখ কথাটি, কেউ বেল দিলে বা দরজায় কড়া নাড়লে চট করে দরজা খুলে দিবে না। আগে তো জানতে হবে, দেখতে হবে, কে এসেছে। তাই না?
রাইয়ান মাথা দুলাল।
এবার মিউ বিড়াল গম্ভীর গলায় বলল,’ এবার আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। ধরো, তোমার সামনে একটা বাঘ।
রাইয়ান বলল, আমার সামনে বাঘ হবে কেন?
আরে সত্যি সত্যি বাঘ না, মিথ্যা মিথ্যা বাঘ। আরে, কল্পনা করো, তোমার সামনে একটা বাঘ। তখন কি হবে, বলত?’
রাইয়ান ভয়ে ভয়ে বলল, ‘বাঘটা আমাকে খেয়েই ফেলবে।‘
মিউ বিড়াল বলল, ‘হুম। এবার বল, ধরো তুমি চিড়িয়াখানায় গেছো। আর তুমি খাঁচার বাঘের সামনে আছো। মানে তোমার সামনে আছে খাঁচায় বাঘ। তখন কি হবে?
রাইয়ান এবার হেসে ফেলল, ‘এবার আমার কিছুই হবে না। কারন বাঘটা খাঁচার ভিতরে। আমাকে ধরতেই পারবে না। আমি একোটা সেলফি তুলবো।‘
মিউ বিড়াল আনন্দের সাথে ওর হাসিটা দেখতে লাগল। মানুষ যখনই হাসে তখন কত সুন্দর যে লাগে। মানুষ কেন সব সময় হাসে না? মিউ বিড়াল বলতে চাইল, রাইয়ান তুমি সব সময় হাসবে। যখন মন খারাপ থাকবে তখনো। দেখবে তোমাকে সবাই ভালোবাসবে। কেউ হাসি উপেক্ষা করতে পারে না।
মিউ বিড়াল সেই কথাগুলো বলা হলো না। সে বলল, ‘ এখন আমরা সেই ভাবে ভেবে নিবো। ধরে নিবো, ডাকাতরা এখন আমাদের কাছে খাঁচার বাঘ। দরজার ওপাশে আছে তাই। মানে দরজার ওপাড়ে আছে। মানে খাঁচার বাঘের মতন অবস্থা। আমি এটাই তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি। এসো এবার তোমার মোবাইলটা থেকে তুমি বাবার যে কথাটা রেকর্ড করেছিলে, যেটা নিয়ে আমি আর তুমি খেলেছিলাম গতকাল। সেটি বাজিয়ে শুনাও, ওদের। দেখ না কি হয়!‘
গতকাল রাইয়ান বাবাকে গিয়ে বলেছিল, ‘কে? কে?’ এই বলা কথা বলতে রেকর্ড করার জন্য। বাবার এই কথাটুকু কেবল রেকর্ড করে রাইয়ান আর মিউ বিড়াল খেলেছিল। সেই কথাটি মিউ বিড়াল মনে করিয়ে দিতেই রাইয়ানের মন ভালো হয়ে গেলো। সাহস ফিরে পেলো। সে দৌড়ে দরজার সামনে গিয়ে মোবাইল থেকে রেকর্ডটা অন করলো।
রেকর্ড করা কথাটা বাজল, বাবা বলেছে, ‘কে? কে?’
রাইয়ান দুই বার বাজিয়ে অফ করলো। আর দরজার আই ভিউ এর ফুটো দিয়ে দেখতে লাগল কি হয়।
মানুষগুলো শব্দটা শুনে একে অন্যের দিকে তাকাল। কোন কথা বলল না। হেঁটে উপরে চলে গেল। তার মানে ডাকাতদের হিসাবে এই বাসার মানুষেরা অতি বুদ্ধিমান, চট করে দরজা খুলেনি। এটা বুঝতে েরেই তারা চলে যাচ্ছে।
রাইয়ান মিউ বিড়ালের দিকে তাকাল। মিউ বিড়াল বলল, ‘কাজ হয়েছে কি?’
রাইয়ান আনন্দে মাথা দুলাল। সে ভাবতে পারছে না ওরা চলে যাবে।
মিউ বিড়াল বলল,’এবার উপরের ফ্লাটের আন্টিকে ফোন দিয়ে বল, ডাকাত এসেছে।‘
রাইয়ান ফোন দিয়ে বলল আন্টিকে সব। আন্টি তাকে খুব আদর করে। তিনি এই কথা শুনতেই বললেন, ‘আমি দরজা খুলে দেখছি, কি হচ্ছে। তুমি কিন্তু দরজা খুলবে না। একদমই না।‘
রাইয়ান বলল, আন্টি প্লিজ দরজা খুলবেন না, ডাকাত এসেছে।
আন্টি কোন উত্তর দিলেন না। ফোনটা কেটে দিতেই আগের ভয়টা আবার ফিরত এলো।
উপর তলার দরজা খোলার শব্দ হলো। রায়ান দ্রুত ফিরে এল দরজার কাছে। দরজার আই ভিউ এর ফুটো দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে। আন্টি সম্ভবত দরজা খুলে বাইরে বের হয়েছে। উপরে কিছু ঘটছে কিনা কে জানে। রাইয়ান শোনার চেষ্টা করতে একবার ডান দিকে কান উঁচু করল। আরেকবার বাম দিকে কান উঁচু করল। হ্যা উপর তলায় ধুরুম ধারুম শব্দ হচ্ছে। পায়ের শব্দ! একই সাথে দরজা লাগানর শব্দ, খুব জোরে।
তখনই আন্টি চিৎকার দিল ,’ডাকাত ডাকাত! ডাকাত, ডাকাত!’
দৌড়া দৌড়ির শব্দ শোনা গেলো। কে যেন দৌড়ে নীচে নামছে বলেই রাইয়ানের মনে হলো। সে খুবই ঘাবড়ে গেছে। মিউ বিড়ালের দিকে তাকালো, সেও খুব ঘাবড়ে গেছে। রাইয়ান বিড় বিড় করে বলল, আমি না দেখে আর চট রে দরজা খুলব না। কখনো না।
যে সিঁড়ি বেয়ে উপর থেকে নেমে এলো সে কিছুখন আগে রাইয়ানদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তিন জনের একজন। হাতে বড় একটা দড়ি।
রাইয়ান ভয়ে ভয়ে ফিস ফিস করে বলল, ‘ডাকাতের হাতে দড়ি।’
মিউ বিড়াল বলল,’এই দড়ি কথাও ওরা বলছিল নীচে দাঁড়িয়ে। এইগুলো দিয়ে ওরা মানুষদের হাত পা বাঁধেবে! কত দুষ্টের দুষ্ট ওরা। ওদের পুলিশে দিতে হবে।’
রাইয়ান দরজার আই ভিউ এর ফুটো দিয়ে মানুষটাকে দেখতে দেখতে আন্টির মতন করে চিৎকার দিল,’ ডাকাত! ডাকাত!’ বলেই বাসার সবগুলো জানালার কাছে দৌড়ে গিয়ে বলতে লাগল, ‘ডাকাত! ডাকাত!‘
রাইয়ান জানালা দিয়ে দেখল, চারদিক থেকে অনেক মানুষ দৌড়ে তাদের বাড়ির দিকে ছুটে আসছে। সম্ভবত আন্টির চিৎকার তারা শুনতে পেয়েই দৌড়ে আসছে অনেক অনেক মানুষ।
হঠাত করে রাইয়ান যেন সাহস ফিরে পেল। তার মনে হতে লাগল, আর ভয় নেই। অনেক মানুষ মানেই তো তাহলে সাহস! অনেক মানুষ মানে অনেক সাহস! সে হেসে ফেললো।
মিউ বিড়াল আবার রাইয়ানকে হাসতে দেখতেই বলল, হাসছো কেন!
রাইয়ান মন খুলে হাসছে। এভাবেই তো হাসবে। হাসতেই থাকবে। ভাবতে ভাবতে মিউ বিড়াল উত্তেজিত গলায় জানতে চাইল, ’কি ঘটছে? কি ঘটছে?’
রাইয়ানও প্রবল আনন্দে উত্তেজিত গলায় বলল,’মানুষেরা ছুটে আসছে।‘
মিউ বিড়াল বললম,’এখনো কি তোমার ভয় করছে?’
রাইয়ান বলল, ‘আরে না। এখন আর ভয় করছে না। অনেক অনেক মানুষ আমাদের বাড়ির দিকে ছুটে আসছে। অনেক মানুষ মানেই হলো সাহস। অনেক মানুষ মানে অনেক অনেক সাহস। এই বিষয়টি আগে জানতাম না। আজ জানা হলো, শিখা হলো। এখন বাঘ খাঁচায় ঢুকে গেছে। ওদের আর কিছু করার নেই, ধরা পড়া ছাড়া।‘
মিউ বিড়াল বলল, ওদের পুলিশে দিতে হবে। আরে আইন আছে না।’ বলে মিউ বিড়াল আনন্দে লাফাতে লাগল।
মিউ বিড়াল লাফানো দেখে রাইয়ানও লাফাতে লাগল আর হাসতে লাগল। লাফাতে লাফাতে রাইয়ান বলল,‘আরে আমি তো ভুলেই গেছি, তোমার সাথে তো আমার আড়ি!‘
মিউ বিড়াল লাফানো থেমে গেল। যেন সে কখনো কোনদিন লাফায়নি, এমন ভাবে চুপ হয়ে বসে গেলো। তারপর সে মন খারাপ করে এক দৌড়ে আলমারির পিছনে পালিয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে রাইয়ান আর জোরে হাসতে লাগল আর লাফাতে লাগল।
মোঃ নোমান সরকার
ছদ্রবেশে রাজা মানুষের সুখ দুঃখে খবর নিতে বের হয়েছেন। সামনে এক জঙ্গল পড়ল। জঙ্গলে ঢুকতেই রাজা কিছু বুঝে উঠার আগেই বাঘ আক্রমণ করে বসল। বাঘের আক্রমণে ঘোড়াটা হারাতে হলেও রাজা বেঁচে গেল। রাজা তবুও ক্ষুধার্ত বাঘটাকে মারল না। তীর ধনুক নামিয়ে নিয়ে রাজা পায়ে হেঁটে ছুটলেন।
প্রচন্ড খিদে লেগেছে রাজার। ঘোড়ার পিঠে খাবার ছিল। কিন্তু বাঘটা আয়েশ করে ঘোড়াটা খাচ্ছিল বলে সাথে থাকা খাবারের আশা বাদ দিয়েছিল। জঙ্গলে রাজা দেখলেন দূরে একটা কুঁড়ে ঘর। আগুনের আশায় সেখানে যেতেই দেখলেন সেই ঘরে বাস করে একটি দরিদ্র পরিবার। তারা দুপুরের খাবার জুটাতে পারেনি বলে না খেয়ে আছে। তাদের থেকে রাজা জানলেন এই জঙ্গলে বাস করে তাদের মতন হাজার দরিদ্র পরিবার। কথাটা রাজার যেন বিশ্বাস হলো না।
রাজা তাই সেখানে থাকা অজস্র পরিবারের কাছে গেলো। বলল, আমি রাজার লোক। তোমাদের খবর নিতে এসেছি। যাকে বলে সেই ভয় পেয়ে তাকিয়ে থাকে। অনেক কষ্টে তাদের থেকে জানা গেলো, তারা আছে ভয়য়াবাহ কষ্টে। তাদের খাবার নেই, কাপড় কিনার সামর্থ্য নেই, ঘর ঠিক করার মতন অবস্থা নেই,শিক্ষা নেই। রাজা প্রচণ্ড হতাশা অনুভব করলেন। তার রাজ্য মানুষের এত কষ্ট! এ যে ভাবাই যায় না, মানাই যায় না।
জঙ্গলের পাশে পাহাড়। সেখানে বাস করে শত শত পরিবার। সেখানেও একই অবস্থা। রাজা কেবল ভাবতে লাগল, এটা আমার রাজ্য! হায় এটা আমার রাজ্য!
পাহাড় আর জঙ্গলের মানুষের কষ্ট দেখে দেখে রাজা ক্লান্ত। সেখান থেকে বের হয়ে রাজা নদীর তীরে এলেন। জঙ্গল আর পাহাড় ঘিরে আছে ছোট্ট একটা নদী। কি অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু সব ম্লান হয়ে গেলো প্রজাদের অবস্থা জেনে। তিনি জঙ্গলের পাশের নদীর ওপারের বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার দুখী প্রজারা বাস করে সারা জঙ্গল জুড়ে। মনটা তার কষ্টে ডুবে গেল।
রাজা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিলেন। রাজা ফিরে এলেন প্রসাদে। প্রাসাদে কত খাবার। খেতে বসে রাজা কিছুই খেতে পারলেন না। তার চোখে ভেসে উঠল সেই পরিবারের মানুষগুলোর চেহারা।
রাজা ডেকে পাঠালেন সেই ছোট রাজ্যের দায়িত্বে আছেন সেই মন্ত্রীকে।
মন্ত্রী এলেন। রাজা প্রশ্ন করল,’ কি হে মন্ত্রী, তুমি যে আমাকে দেখতে এলে, যে জাকজমক অবস্থা, বিশাল হাতি বাহিনী সাথে করে এত হাতি তো রাজারও নেই।
মন্ত্রী লজ্জা পাওয়া গলায় বললেন, ‘ রাজার অনেক দয়া।’
হাতিগুলো স্বর্ণ দিয়ে ভালো সাজিয়েছ। তমার কাজ পছন্দ হয়েছে।’
মন্ত্রী বলল, রাজার অনেক দয়া।”
রাজা হেসে বলল, এবার রাজ্যের প্রজাদের গল্প বলল,খাজনা ঠিক মতন আদায় হচ্ছ তো?’
মন্ত্রী বলল,’ হুজুর আমি তো ঠিক মতন খাজনা দেই। এতটুকু কম হয় না কোন বছর।’
রাজা বললেন, তোমার এলাকার মধ্যে ঐ কালো পাহাড় আর জঙ্গলও আছে। তা সেখানে আমার প্রজারা কেমন আছে সেখানে?’
মন্ত্রী বলল, ‘ওরা আছে মহা সুখে। স্বর্ণ আর অলংকারে ডুবে থাকে প্রত্যেক প্রজা। এমনকি জঙ্গলে যে প্রজারা থাকে তারাও এত ধনী যে বিলাসিতা করে তারা জঙ্গলে থাকে। মহা আনন্দেই তাদের দিন কাটে।’
রাজা বলল, ‘না খেয়ে থাকে কয় জনা?’
মন্ত্রী অবাক হয়ে বলল, ‘একটিও না, একটিও না। আপনি নিজে এসে একবার বেরিয়ে যান।’
রাজা তাকে বরখাস্থ করলেন, কালো পাহাড়ে প্রজাদের সামনে তাকে ফাঁসির ব্যবস্থা করলেন। আরেকজনকে বানালেন মন্ত্রী সেখানের। তাকে ডেকে দেখালেন আগের মন্ত্রীর মিথ্যা বলার পরিনিতি আর প্রজাদের প্রতি অবহেলার প্রতিশোধ।
সন্ধ্যায় রাজা প্রাসাদে ফিরতেই রানী এসে বললেন, ‘মহারাজ আমাদের প্রজাদের মনে অনেক কষ্ট। অথচ আমরা কেন সেটা জানতে পারলাম না। এটা আমাকেও কষ্ট দিচ্ছে।’
রাজা বললেন, ‘বছরের পর বছর একজন অযোগ্য মন্ত্রীর জন্য আমার প্রজারা কি ভয়াবাহ কষ্টই না করেছে। প্রজাদের জন্যই আমি রাজা।’
রানী বললেন, ‘এর জন্য রাজ্যের প্রত্যেক প্রজাই আপনাকে এত ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে।’
রাজা বললেন, আমি খুবই লজ্জিত প্রজাদের কাছে। আমার প্রজারা না খেয়ে থাকে! রানী! প্রজারা কেমন আছে, এই খবর আরো ভালো ভাবে নিতে হবে। তখনই হব আমি প্রজাদের জন্য যোগ্য একজন রাজা।
মোঃ নোমান সরকার
সমুদ্রের একটা ছোট্ট দ্বীপ। অজস্র ফুলের বাগান বলে দেয় এখানে মানুষ বাস করে, যাদের মন অনেক বড়। যারা ফুল ভালোবাসে তাদের মন তো বড় হতেই হবে। তা না হলে কি দিগন্ত জুড়ে ফুলের বাগান থাকে?
দ্বীপে বিশাল সেই বাগানের মাঝে কিছুটা উঁচুতে আছে প্রকাণ্ড এক বাড়ি। এটি রাজার বাড়ি। সেই রাজার এক ছোট মেয়ে নাম ইমাইরা। তাকে প্রত্যেক সকালে নতুন নতুন ফুল দিয়ে সাজানো হয়। রানী পাশে বসে তা দেখে। এই হল সেই বাড়ির সকালের চিত্র। কিন্তু একদিন সকালটা আলাদা রকমের হয়ে উঠল।
দ্বীপের কাছেই অতি ভোরে একটা বড় জাহাজ আসল। সেই জাহাজ থেকে অনেক গুলো ছোট নৌকায় করে কিছু মানুষ দ্বীপে নামল। তাদের হাতে তরবারি। আর তারা দ্বীপের প্রতিদিনের সকালের চিত্রটা উল্টে দিল।
রাজা ভোরে উঠে নামাজ পড়ে বাগানে হাঁটেন। সাথে হাঁটে রানী আর ইমাইরা। রাজার কাছে খবর নিয়ে এলো এক পায়রা। পায়রার পায়ে ছোট চিরকুট। তিনি পড়তেই তা রানীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোমরা প্রাসাদে ফিরে যাও।’
রাজা বাগান থেকে বের হয়ে রাজদরবারে এলেন। বিপদের ঘণ্টা বাজানো হয়ে গেছে। সৈন্যরা ছুটে আসতে শুরু করেছে। সেনাপতি এসে বললেন, ‘আদেশ করুন।’
রাজা সেনাপতিকে নিয়ে এলো প্রাসাদ থেকে অনেক দূরে এক দুর্গে। দুইজনে উঠে গেল অনেক উঁচুতে যেখান থেকে সমুদ্রের বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়।
রাজা সেনাপতি দেখল, জাহাজ থেকে ছোট ছোট নৌকায় অনেক মানুষ অস্ত্র সহ যেমন নেমেছে। নৌকাগুলো তীরের কাছাকাছি আসতেই জাহাজ থেকে আগুনের গলা নিক্ষেপ করতে লাগল। আর তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে লাগল। জাহাজ থেকে একের পর এক গোলা ছুটে এসে পড়তে লাগল তীরের সামনে পিছনে। জাহাজও এগিয়ে আসছে। তখন রাজা সেনাপরিকে ইশারা করতেই বিশাল বিশাল আগুনের গোলা আরো দ্রুত ছুটে গিয়ে গিয়ে পরল সেই বড় জাহাজটায়। আর কিছুখন পর জাহাজটা ডুবে গেল। শত্রু পক্ষ ছোট ছোট নৌকাগুলো নিয়ে পালাতে লাগল। তীরে যারা নেমেছিল তারাও নৌকা ভাসিয়ে পালাতে লাগল।
রাজা আর সেনাপতি যেখানে দাড়িয়ে সেখান থেকে দ্বীপের চারদিকের সবটাই দেখা যায়। দূর সমুদ্রে থাকা জাহাজটা কতটা দূরে তার হিসাব কষে নিতে সহজ হয়েছিল রাজার। সেইভাবেই আগুনের গোলাটা ফেলা। সেনাপতি রাজার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, জাহাজ তো ডুবল এবার ‘আমরা ওদের নৌকাগুলো ডুবিয়ে দেই?’
রাজা বলল, ‘না, থাক। ওদের শাস্তি যথেষ্ট হয়েছে। জাহাজের মানূষেরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পরেছে। নৌকা থেকে ওদের উদ্ধার করে তারা দেশে ফিরে যাক। আর কখনো এই রাজ্য আক্রমনের সাহস না করুক।’
রাজার কথা শেষ না হতেই সমুদ্রে দেখা মিলল অদ্ভুত এক জীবের। রাজা এই জীবটাকে চিনে এরা হচ্ছে সমুদ্র দানব। সেই ছেলেবেলায় দেখেছিল। আজ আবার দেখল। কিন্তু তীরের কাছাকাছি সাধারণত এরা কখনো আসে না বলে শুনেছে। রাজা অবাক হল। জীবটা সমুদ্রের পানিতে লাফিয়ে উঠে দ্রুত ছুটে গেল নৌকার দিকে তারপর একে একে সব নৌকা মুখের ভিতর ঢুকিয়ে নিল। তারপর সমুদ্রে ভেসে থাকা একটা একটা করে মানুষ খেতে শুরু করল। ব্যাপারটা এত দ্রুত হল রাজা কি করবে ভেবে পেল না।
সেনাপতি মাথায় হাত দিয়ে আছে। আর চিৎকার করে বলছে,’ওটা তো আমাদের রাজ্যে হানা দিবে।’
রাজা ভাবলেন, বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই আসে। রাজা ইশারা করল আগুনের গোলা নিক্ষেপের জন্য। কিন্তু গোলাটি দানবের গায়ে লাগল না। দানব খুব দ্রুত সরে যেতে পেরেছিল বলে নিজেকে রক্ষা করতে পারল। এদিকে একটি গোলা নিক্ষেপ করতেই জানা গেল আর গোলা নেই। রাজা সেনাপতির দিকে তাকালেন। সেনাপতি কি বলবেন ভেবে পেলেন না। এখন উপায়।
দানব ক্রমশ এগিয়ে আসছে তীরের দিকে। রাজা দেখলেন, নীচের সব সৈন্যরা যেন অস্থির হয়ে উঠেছে। কারন দানবের সাথে কেউ তো যুদ্ধ করে পারবে না। যেন সবাই পালিয়ে যাবার কথা ভাবছেন। ওদের গতিবিধি তেমনটাই বলছে।
রাজা সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সেনাপতি এখন উপায় বলো।’
সেনাপতি বলল, আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি ভেবেছি এই রাজ্য কেউ হানা দিবে না, তাই এই গোলার বিষয়টা নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু সৈন্যদের আমি উচ্চ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। তারা যে কোন বিপদে যথেষ্ট। কিন্তু এখন তো আমাদের আগুনের গোলা দরকার।’
রাজা বলল, ‘ভাবতো একবার, দানবকে মারার আমাদের হাতে আর কোন গোলা নেই। দানব উঠে আসবে। তারপর আমাদের বাগানগুলো তছনছ করে দিবে। আমাদের বাড়িগুলো ভেঙ্গে ফেলবে। মানুষগুলোকে ধরে ধরে খাবে। আর তুমি বলছ, আগুনের গোলার বিষয়টি নিয়ে ভাবিনি! এ তুমি কি করেছ? এ কেমন সেনাপতি তুমি।’
সেনাপতি লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলল। আর তখনই তীর থেকে ডাঙ্গায় এসে উঠল দানবটা। দানব ডাঙ্গায় উঠে এত জোরে হুকার দিল যে, ভয়ে সবাই শুয়ে পরল। তীব্র শব্দে চারদিক যেন কেঁপে উঠল। ঠিক তখনই একটি আগুনের গোলা গিয়ে পড়ল দানবের দেহে। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল দানব।
সেনাপতি ঘাড় ঘুরে রাজার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকাল।
রাজা অনেকখন হাসল। তারপর ধীর গলায় বলল, আমি এই রাজ্যের রাজা। আমাকে ভাবতে যেমন হয়, তেমনি দেখতে হয় সব কিছু। সবাই থাকার পরেও প্রজাদের সুখ আর নিরাপত্তা নিয়ে আমাকে খেয়াল রাখতে হয়। এখন মনে হচ্ছে, আগুনের গোলা কতগুলো ছিল ,তুমি তাও জানো না। । আমার আদেশে আরো এক শত দশটি গোলা পর পর সাজিয়ে আড়ালে রাখা হয়েছিল। কারন যে কেউ ভুল করতেই পারে বা আরো অতিরিক্ত দরকার হতেই পারে। সেনাপতি হতে পারে না?
সেনাপতি চুপ করে আছে। সে ভয়ে কাঁপছে। রাজা বলল, তোমার উপর আমি ভরসা করেছি। তবুও আমি যেহেতু রাজা তাই আমার প্রজাদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়েছে। এখন বলো, কি শাস্তি তোমার হওয়া উচিত?
সেনাপতি বলল, যা আপনি শাস্তি দিবেন, তাই মাথা পেতে নিব। আমার মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে।’
রাজা বলল, ‘তোমাকে সেনাপতি থেকে বরখাস্ত করা হল এবং সাধারণ একজন সৈনিক হিসাবে তুমি কয়েক বছর থাকবে। তারপর আপন যোগ্যতায় আবার যদি জায়গা করে নিতে পার তবে এই পদবী আবার ফিরে পাবে। আমি আশা করি সেই যোগত্যা তোমার আছে।’
সেনাপতি বলল, ‘আমি আমার শাস্তি মাথা পেতে নিলাম।’
রাজা বলল,’ দানবের কথা বাদ দিলাম। যারা এই ভোরে রাজ্য আক্রমণ করেছিল। তারা জোয়ার ভাটার কারনে যদি ভোরে না এসে রাতে তীরের কাছে আসতে পারত আর আক্রমন রাতে করত বা এই সময় আমি যদি শিকারে থাকতাম। তবে এতক্ষণে আমার রাজ্য পুড়ে ছাই হয়ে যেত। কি সেনাপতি ছাই হয়ে যেত না।’
সেনাপতি চুপ করে আছে, সে প্রবল ভাবে কাঁপছে।
সেনাপতির দিকে না তাকিয়ে রাজা বলল, ‘এসো আমার সাথে।’
সেনাপতি রাজার পিছু পিছু নেমে গেল নীচে। আর অবাক বিস্ময়ে দেখল উঁচু সরু দালানের নীচে আর একটা সিঁড়ি। তারা সেই সিঁড়ি বেয়ে নামতেই সেনাপতি অবাক বিস্ময়ে দেখল মাটির নীচে বিশাল এক জায়গা, সেখানে শত শত শ্রমিক গোলা বানাচ্ছে। রাজা তাকে একটা গুপ্ত ঘরে প্রবেশ করাল, যেখানে শতশত গোলার মজুদ!
সেনাপতি আবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে রাজার সামনে সে একটা বাচ্চা ছেলে।