Home কিশোর গল্প কৃপণ (কিশোর গল্প)

কৃপণ (কিশোর গল্প)

by Admin

মোঃ নোমান সরকার

এক গ্রামে এক কৃপণ লোক বাস করত। তা নাম জমির। সারাক্ষণ সে টাকা , আয়, ব্যয়, খরচ নিয়েই ভাবত। সে বিয়ে করেনি খরচের কথা ভেবে। ঘরে বউ এলে খাবার বেশী লাগবে আবার সন্তান হলে খরচ বেড়ে যাবে। তাই সে ঠিক করেছে, এ জীবনে আর বিয়েই করবেনা।

 গ্রামের মানুষদের সাথে এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক হয় , ঝগড়াও হয়। এই পর্যন্তই। সে তার মতন আছে। দূর থেকে গ্রামের মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। সে এসব গায়ে মাখেনা।

 একদিন ভোরে তার ঘুম ভেঙ্গেছে। হাই তুলতে তুলতে বিছানায় উঠে বসল। তারপর কিসব যেন ভাবল। তারপর খাট থেকে যেই পা নিচে মাটিতে ফেলতে গেল। তখনই কে যেন বলে উঠল ,’ পা উঠাও।‘  

খুব ধীরে, যেন কেউ বলল। খুব আস্তে শুনা গেলেও স্পষ্ট!

ঘরে কেউ নেই! জানালা বন্ধ, শীতের দিন। জমির সারা ঘরে তাকালো। টিনের একটা ঘরে সে একাই থাকে। গ্রামের এক কোনায় তার এই ঘর ,এদিকটায় তেমন কেউ আসেনা। সে ভয়ে ভয়ে আবার পা ফেলতে গেল। আবার সেই একই ধমকের সুরে  আদেশ। খুব ধীরে আর স্পষ্ট!

সে ভয়ানক চমকে দেখল তার খাটের শেষ মাথায় ক্ষুদ্র আলো। দুই আলো পাশাপাশি জ্বলছে! ধীরে ধীরে জমির কাছে গেল। শব্দটা সেই দিক থেকেই এসেছে। কাছে যেতেই বুঝল উজ্জ্বল এই দুই আলো হচ্ছে চোখ। আর চোখ দুইটি একটি পিঁপড়ার! বেশ বড় পিঁপড়া! 

 অবাক বিস্ময়ে দেখল এই পিঁপড়া কথা বলছে! জমিরের মুখ হা হয়ে গেলো। চোখ বড়  বড় হয়ে গেলো। দেখতে পিঁপড়ার চেয়ে একটু বড় পিঁপড়ারটা বলল ,’ আমি পিঁপড়াদের রাণী।‘    

 জমির হা করা মুখ আরও বড় হল। আর মুখ হা করে ঘরে প্রবেশ করা ভোরের  সামান্য আলোতে দেখলো, লাখ লাখ পিঁপড়া তার ঘরের মেঝেতে! এক লাফে সে বিছানায় উঠে এলো। সে প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠলো , ‘আমি এখনও ঘুমাচ্ছি ! স্বপ্ন দেখছি ! স্বপ্নের মধ্যে জেগে উঠেছি।‘

রাণী পিঁপড়া সেকথা শুনতে পেয়ে বলল ,’ এই মানুষ ! মোটেও তুমি ঘুমাচ্ছ না।‘

জমির বলল ,’ আমি স্বপ্নের মধ্যে জেগেছি ! এখন আমি স্বপ্নের মধ্য ঘুমাবো! এক্ষণই ঘুমাবো ‘!

জমির আর ঘুমাতে পারলনা। তারপর অনেক সময় কেটে গেল। একটা সময়ের পর সে বুঝল ,সে স্বপ্ন দেখছে না! যা ঘটছে তা বাস্তব!  

রাণী পিঁপড়া বলল ,’ আমরা প্রতি বছর বসন্তের প্রথম পূর্ণিমায় আগের ভোরে দলবল নিয়ে মাটির উপড়ে আসি। মধ্যরাত পর্যন্ত থাকি। তারপর আবার ফিরে যাই। আজকের রাতটা আমাদের উৎসবের রাত। বছরে একবারই আমরা মাটির উপরে উঠে আসি।‘   

জমির পিপড়ার রাণীর কথাগুলো শুনে ,শুনে যায়! কোন কথা বলে না , কথা খুঁজেও পায়না ! কি বলবে , কি বলা যেতে পারে! মাঝে মাঝে মাথার চুল টেনে ধরে। চোখ বন্ধ করে ওঁ ! ওঁ! ওঁ! করে। তারপর কেটে গেল অনেক সময়। জমিরের মনে হল যেন এক যুগ কেটে গেছে বা যুগের পর যুগ।  

যতই সময় যাচ্ছে জমিরের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। সে বলতে থাকল ,’ আমাকে ছেড়ে দাও । আমাকে যেতে দাও। আমার আজ যে ক্ষতি হল তা সারা জীবনেও মিটবে না।‘

রাণী পিঁপড়া অবাক গলায় বলল ,’ প্রতি বছরই এই সময়ে একজন অথবা এক পরিবার আটকা পরে আমাদেরে আগমনে এমনটা খুব কমই হয়েছে। জঙ্গলেই আমরা উৎসব করা হয় এক দিন , একরাতের জন্য।  কিন্তু এমন কথা তো শুনিনি!  সবাই আমদের ভয়ে অস্থির থেকে টু শব্দটা করে না। আর তুমি বিরক্তই করে যাচ্ছ? আমরা ইচ্ছে করলে তোমাকে খেয়ে ফেলতে পারি। ভয় হচ্ছে না এতটুকু? ভারি অদ্ভুদ কথা! ভারি অদ্ভুদ কথা!’   

জমির কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘বর্গার কৃষকরা ধান ক্ষেতে এসে বসে থাকবে , তাদের আজকের দিনের টাকা বেহুদা আমাকে দিতে হবে। আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল যে। তোমরা এসব বুঝবেনা। তুমি আর কাউকে পেলে না। আমার এত বড় ক্ষতিটা করলে।‘

রাণী পিঁপড়া বলল ,’ এ আমরাই বা কোথায় এলাম! ভয় নেই এ মানুষটার! কি অদ্ভুদ ! এই তুমি থাম তো। আমাদের আনন্দ করতে দাও। আর ঘরে কোন খাবারই নেই কেন। চিনি থাকে না এমন ঘরে প্রথম এলাম।

জমির অশান্ত গলায় বলল,’ চিনির অনেক দাম। তাই আমি চিনি খাই না। আর অন্য জিনিসের ও অনেক দাম।‘

একটু পর পর জমির কাঁদতে কাঁদতে একই কথা বলে যেতে লাগল যে, আমার অনেক ক্ষতি হল।

তখন রাণী পিঁপড়া বলল , আমাদের আনন্দ করতে দাও। আর যাবার আগে তোমাকে তো সোনার মোহর দিব ,প্রত্যককেই তো দেই। এখন চুপ কর।‘

সোনার মোহরের কথা শুনে জমির একদম পাল্টে গেল। ‘সোনার মোহর! সোনার মোহর!’ বলে চেঁচাতে লাগল। 

রাণী পিঁপড়া মহা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুমি কি চুপ করবে? আমাদের আনন্দ করতে দিবে? আচ্ছা দাঁড়াও তোমাকে চুপ করাচ্ছি। এই যে তোমার ঘর, এই মাটির অনেক নিচে আছে এক সোনার নৌকা! তুমি কি তা জানো?  তুমি যদি চাও ওখানে যেতে পারো। কিন্তু আমাদের আনন্দ করতে দাও। তোমার চেঁচামেচিতে এই প্রথম আমরা কোন আনন্দই করতে পারছি না।‘  

জমির চুপ হলো।  

‘তোমার সেখানে যাওয়া উচিৎ। সোনার নৌকাটা দেখে হয়তবা তোমার ভালো লাগবে। আর আমরাও রেহাই পাব। কারন তুমি বড়ই বিরক্ত করছ। তুমি কি সেখানে যেতে চাও ?’   

জমিরের শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। বলে কি সোনার নৌকা! সোনার! বলে কি সোনার নৌকা! খুব উচু গলায় জমির চেঁচেয়ে বলল ,’আমি সোনার নৌকা দেখব! আমি সোনার নৌকা দেখব !’ বলতে বলতে থেমে গেল। তারপর ভ্রু কুচকে জানতে চাইল , মাটির নীচে সোনার নৌকা এলো কোথা থেকে?’    

রাণী পিঁপড়া রেগে গিয়ে বলল,’ তুমি কি চুপ করবে?’

জমির বলল, আগে বলো সোনার নৌকা কিভাবে খুজে পেলে? কিভাবে এলো?’

রাণী পিঁপড়া প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলল, ইচ্ছে করছে তোমাকে খেয়েই ফেলি। তুমি আমাদের এত বিরক্ত করছ! এমনটা কখনো কোনদিন হয়নি।‘

জমির যেন শুনতে পেল না। সে অস্থির হয়ে জানতে চাইল,’ কিভাবে এলো আমার ঘরের নীচে সোনার নৌকা? তুমি কি করে তা জানো?‘    

রাণী পিঁপড়া উড়ে এসে তার নাকের উপর বসল। রেগে বলতে লাগল,’অনেক কাল আগে তোমার এই বাড়ির জায়গাটা ছিল নদীর তীর আর তখনকার রাজার ঘাট ছিল এটা। রাজার বড় নৌকার শখ ছিল। একদিন তিনি সোনার নৌকা তৈরির আদেশ দিলেন। নৌকা তৈরি করতে একোটা বিশাল গুহার মত ঘর তৈরি করা হলো। একদিন নৌকা তৈরি হয়ে গেল। তারপর পরই নদীর ভাঙ্গন শুরু হলো। ভাঙ্গনের কারণে এই  রাজার ঘাট ,রাজ বাড়ি সব নদীর নীচে চলে গেল। কিন্তু নদীর তীরের এই জায়গা ভাঙ্গল না, দেবে গেল সেই সোনার নৌকা সহ।‘         

জমির বলল,’ তুমি দেখছি অনেক খবর রাখ!’ 

রাণী পিঁপড়া বলল, ‘মানুষই কেবল তার নিজের কথাই ভাবে। মানুষ তো লোভী। তোমাদের প্রথম মানুষও লোভী ছিল। মানুষ ভয়ানক লোভী। তুমি যাও। এখানে থাকলে তোমার বিরক্তে আমাদের সব আনন্দ নষ্ট হইয়ে যাচ্ছে।‘

জমির লাফিয়ে উঠে বলল , ‘এখনি যেতে চাই।‘

‘অপেক্ষা কর তবে। সুরঙ্গ করতে বলে দিচ্ছি আমার সৈন্যদের। তবে একদম চুপ।‘

জমির চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলো। 

জমির বালিশের নীচে থেকে টর্চটা নিলো। এটি তার সঙ্গী। যখন সে বাড়ি থেকে বের হয়, এটি তার সঙ্গী। কারন বাড়ি ফিরতে প্রায়ই রাত হয়। এটি হাতে নিতেই তার সাহস পায় যেন। জমির টর্চ লাইট সঙ্গে নিলো।     

রাণী পিঁপড়া বলল, ‘এবার তুমি ঘুমাও। হায় মানুষ! তুমি এখানের আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলে !’

জমির দেখল তার ঘুম পাচ্ছে। আরে অস্তে অস্তে সে ঘুমে ঢলে পরছে। সে চোখ বড় বড় করে রাখার চেষ্টা করল। পারলো না । ঘুমিয়ে পরলো।  

ব্যথা পেয়ে ঘুম ভাঙ্গল জমিরের। মনে হল তার হাতে কোন পোকা কামড়ালো।  চারদিক অন্ধকার। দিন হলে তো বন্ধ জানালার ছিদ্রু দিয়ে আলো আসতো। কি সব অদ্ভুদ স্বপ্ন দেখছিল সে! লক্ষ লক্ষ পিঁপড়া, পিঁপড়া রাণী কথা বলছিল! কি অদ্ভূত স্বপ্ন!  

এমন অদ্ভুদ স্বপ্ন সে জীবনে দেখেনি , শুনেওনি ! তারপর তার ঘুমের আগের দৃশ্য মনে হল। সোনার নৌকার কথা মনে হতেই সে লাফিয়ে উঠে বসল। তখনই ব্যথাটা বাড়ছে যে টের পেল। হাতে কি কামড় দিল! মশা তো নয় ,অন্য কিছু।

একটা মশারি কেনা দরকার। অসুস্থ হলে ডাক্তারের পিছনে খরচ অনেক। আর ডাক্তাররা মানেই তো অনেক অনেক টাকা। নাহ , আজই বাজারে গিয়ে ছোট্ট একটা মশারি কিনতে হবে। পুড়ান মশারি পাওয়া গেলে ভালো হত। দাম আরও কম হত। সে শুয়ে পরল আবার। অতি ভোরে উঠে জমিতে যেতে হবে। প্রায় তিন মাইল হেঁটে যেতে হবে। অবস্য অর্ধেক পথ রিক্সায় যাওয়া যায়। কিন্তু রিক্সাওয়ালা সব ডাকাত  হয়ে গেছে। আর দরকারই বা কি। হাঁটলে স্বাস্থ্য ভাল থাকে। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে সোনার নৌকার কথা মনে হল। সোনার নৌকা ! আহ ! সত্যি যদি এমন হত ! ঠিক তখনই হাতে বলতে গেলে একই জায়গায় আরেকটা কামড় দিল কোন পোকা!  

‘আরে’ বলে আরেকটা হাত সরাতেই সে টের পেল টর্চটা! দ্রত হাতে নিতেই মনে হল এটা তো এখানে থাকার কথা না। টর্চ থাকে বালিশের নীচে। বালিশটা তবে গেল কোথায়?  

তখন আবার মনে হল টর্চ বালিশের নীচ থেকে হাতের কাছাকাছি এলো কিভাবে! তারমানে কি! খুব সোজা সে এখনও স্বপ্নের মধ্যেই আছে! তারমানে সে সবপ্নের মধ্যে উঠে ছিল। আবার সবপ্নের মধ্যে। সে একবার ঘুমিয়ে পরেছিল। আবার সেই সবপ্নের মধ্যে আবার জেগেছে! তার খুব হাসি পেল। এসব কি হচ্ছে! এসব কি ঘটছে! আরে ভোরে উঠতে না পারলে তো কৃষকদের খামখা টাকা দিতে হবে। তখনই মনে হল আবার সোনার নৌকার কথা। লাফিয়ে উঠে, হাতে টর্চ টা নিয়ে অন করল টর্চ। সে চমকে উঠল। বিশাল একটা গুহার শুয়ে আছে সে।  

জমির আলো ফেলে ফেলে সোনার নৌকা দেখতে লাগল। সে আনন্দে, অস্থিরতায় আত্মহারা হয়ে সোনার নৌকা স্পর্শ করতে লাগল।  

 বলতে গেলে প্রচন্ড আনন্দ সাথে নিয়ে একটা সময় জমির ঘুমিয়ে গেল। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন সে আবার আবিস্কার করল সে অন্ধকারেই শুয়ে আছে। একে একে সব কথা তার মনে পড়ল। তখনই সে দেখল ক্ষুদ্র দুইটি আলো। সেই চোখ! পিঁপড়ার রাণী!

রাণী পিঁপড়া কথা বলে উঠতেই সেই কথার প্রতিধ্বনি হলো গুহাটায়। ‘সোনার নৌকা দেখে তোমার কেমন লাগল?’

জমির অস্থির গলায় বলল,’আমি সোনার নৌকাটি  নিতে চাই?’

‘হ্যা সেটা তোমাকে দেওয়া হবে। এটি তোমার।‘

‘আমার?’ জমির চিৎকার করে বলে উঠোলো।

‘হ্যা তোমার।‘  

জমিত প্রচণ্ড অস্থির গলায় বলল,‘আমি এটিকে কিভাবে উপরে নিয়ে যাব।‘

‘নিয়ে যাওয়া তো যাবে না।‘

‘তাহলে?’

 ‘তুমি এখানেই থাকবে। আমাদের সাথে।‘

You may also like

Leave a Comment