মোঃ নোমান সরকার
সমুদ্রের একটা ছোট্ট দ্বীপ। অজস্র ফুলের বাগান বলে দেয় এখানে মানুষ বাস করে, যাদের মন অনেক বড়। যারা ফুল ভালোবাসে তাদের মন তো বড় হতেই হবে। তা না হলে কি দিগন্ত জুড়ে ফুলের বাগান থাকে?
দ্বীপে বিশাল সেই বাগানের মাঝে কিছুটা উঁচুতে আছে প্রকাণ্ড এক বাড়ি। এটি রাজার বাড়ি। সেই রাজার এক ছোট মেয়ে নাম ইমাইরা। তাকে প্রত্যেক সকালে নতুন নতুন ফুল দিয়ে সাজানো হয়। রানী পাশে বসে তা দেখে। এই হল সেই বাড়ির সকালের চিত্র। কিন্তু একদিন সকালটা আলাদা রকমের হয়ে উঠল।
দ্বীপের কাছেই অতি ভোরে একটা বড় জাহাজ আসল। সেই জাহাজ থেকে অনেক গুলো ছোট নৌকায় করে কিছু মানুষ দ্বীপে নামল। তাদের হাতে তরবারি। আর তারা দ্বীপের প্রতিদিনের সকালের চিত্রটা উল্টে দিল।
রাজা ভোরে উঠে নামাজ পড়ে বাগানে হাঁটেন। সাথে হাঁটে রানী আর ইমাইরা। রাজার কাছে খবর নিয়ে এলো এক পায়রা। পায়রার পায়ে ছোট চিরকুট। তিনি পড়তেই তা রানীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোমরা প্রাসাদে ফিরে যাও।’
রাজা বাগান থেকে বের হয়ে রাজদরবারে এলেন। বিপদের ঘণ্টা বাজানো হয়ে গেছে। সৈন্যরা ছুটে আসতে শুরু করেছে। সেনাপতি এসে বললেন, ‘আদেশ করুন।’
রাজা সেনাপতিকে নিয়ে এলো প্রাসাদ থেকে অনেক দূরে এক দুর্গে। দুইজনে উঠে গেল অনেক উঁচুতে যেখান থেকে সমুদ্রের বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়।
রাজা সেনাপতি দেখল, জাহাজ থেকে ছোট ছোট নৌকায় অনেক মানুষ অস্ত্র সহ যেমন নেমেছে। নৌকাগুলো তীরের কাছাকাছি আসতেই জাহাজ থেকে আগুনের গলা নিক্ষেপ করতে লাগল। আর তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে লাগল। জাহাজ থেকে একের পর এক গোলা ছুটে এসে পড়তে লাগল তীরের সামনে পিছনে। জাহাজও এগিয়ে আসছে। তখন রাজা সেনাপরিকে ইশারা করতেই বিশাল বিশাল আগুনের গোলা আরো দ্রুত ছুটে গিয়ে গিয়ে পরল সেই বড় জাহাজটায়। আর কিছুখন পর জাহাজটা ডুবে গেল। শত্রু পক্ষ ছোট ছোট নৌকাগুলো নিয়ে পালাতে লাগল। তীরে যারা নেমেছিল তারাও নৌকা ভাসিয়ে পালাতে লাগল।
রাজা আর সেনাপতি যেখানে দাড়িয়ে সেখান থেকে দ্বীপের চারদিকের সবটাই দেখা যায়। দূর সমুদ্রে থাকা জাহাজটা কতটা দূরে তার হিসাব কষে নিতে সহজ হয়েছিল রাজার। সেইভাবেই আগুনের গোলাটা ফেলা। সেনাপতি রাজার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, জাহাজ তো ডুবল এবার ‘আমরা ওদের নৌকাগুলো ডুবিয়ে দেই?’
রাজা বলল, ‘না, থাক। ওদের শাস্তি যথেষ্ট হয়েছে। জাহাজের মানূষেরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পরেছে। নৌকা থেকে ওদের উদ্ধার করে তারা দেশে ফিরে যাক। আর কখনো এই রাজ্য আক্রমনের সাহস না করুক।’
রাজার কথা শেষ না হতেই সমুদ্রে দেখা মিলল অদ্ভুত এক জীবের। রাজা এই জীবটাকে চিনে এরা হচ্ছে সমুদ্র দানব। সেই ছেলেবেলায় দেখেছিল। আজ আবার দেখল। কিন্তু তীরের কাছাকাছি সাধারণত এরা কখনো আসে না বলে শুনেছে। রাজা অবাক হল। জীবটা সমুদ্রের পানিতে লাফিয়ে উঠে দ্রুত ছুটে গেল নৌকার দিকে তারপর একে একে সব নৌকা মুখের ভিতর ঢুকিয়ে নিল। তারপর সমুদ্রে ভেসে থাকা একটা একটা করে মানুষ খেতে শুরু করল। ব্যাপারটা এত দ্রুত হল রাজা কি করবে ভেবে পেল না।
সেনাপতি মাথায় হাত দিয়ে আছে। আর চিৎকার করে বলছে,’ওটা তো আমাদের রাজ্যে হানা দিবে।’
রাজা ভাবলেন, বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই আসে। রাজা ইশারা করল আগুনের গোলা নিক্ষেপের জন্য। কিন্তু গোলাটি দানবের গায়ে লাগল না। দানব খুব দ্রুত সরে যেতে পেরেছিল বলে নিজেকে রক্ষা করতে পারল। এদিকে একটি গোলা নিক্ষেপ করতেই জানা গেল আর গোলা নেই। রাজা সেনাপতির দিকে তাকালেন। সেনাপতি কি বলবেন ভেবে পেলেন না। এখন উপায়।
দানব ক্রমশ এগিয়ে আসছে তীরের দিকে। রাজা দেখলেন, নীচের সব সৈন্যরা যেন অস্থির হয়ে উঠেছে। কারন দানবের সাথে কেউ তো যুদ্ধ করে পারবে না। যেন সবাই পালিয়ে যাবার কথা ভাবছেন। ওদের গতিবিধি তেমনটাই বলছে।
রাজা সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সেনাপতি এখন উপায় বলো।’
সেনাপতি বলল, আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি ভেবেছি এই রাজ্য কেউ হানা দিবে না, তাই এই গোলার বিষয়টা নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু সৈন্যদের আমি উচ্চ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। তারা যে কোন বিপদে যথেষ্ট। কিন্তু এখন তো আমাদের আগুনের গোলা দরকার।’
রাজা বলল, ‘ভাবতো একবার, দানবকে মারার আমাদের হাতে আর কোন গোলা নেই। দানব উঠে আসবে। তারপর আমাদের বাগানগুলো তছনছ করে দিবে। আমাদের বাড়িগুলো ভেঙ্গে ফেলবে। মানুষগুলোকে ধরে ধরে খাবে। আর তুমি বলছ, আগুনের গোলার বিষয়টি নিয়ে ভাবিনি! এ তুমি কি করেছ? এ কেমন সেনাপতি তুমি।’
সেনাপতি লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলল। আর তখনই তীর থেকে ডাঙ্গায় এসে উঠল দানবটা। দানব ডাঙ্গায় উঠে এত জোরে হুকার দিল যে, ভয়ে সবাই শুয়ে পরল। তীব্র শব্দে চারদিক যেন কেঁপে উঠল। ঠিক তখনই একটি আগুনের গোলা গিয়ে পড়ল দানবের দেহে। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল দানব।
সেনাপতি ঘাড় ঘুরে রাজার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকাল।
রাজা অনেকখন হাসল। তারপর ধীর গলায় বলল, আমি এই রাজ্যের রাজা। আমাকে ভাবতে যেমন হয়, তেমনি দেখতে হয় সব কিছু। সবাই থাকার পরেও প্রজাদের সুখ আর নিরাপত্তা নিয়ে আমাকে খেয়াল রাখতে হয়। এখন মনে হচ্ছে, আগুনের গোলা কতগুলো ছিল ,তুমি তাও জানো না। । আমার আদেশে আরো এক শত দশটি গোলা পর পর সাজিয়ে আড়ালে রাখা হয়েছিল। কারন যে কেউ ভুল করতেই পারে বা আরো অতিরিক্ত দরকার হতেই পারে। সেনাপতি হতে পারে না?
সেনাপতি চুপ করে আছে। সে ভয়ে কাঁপছে। রাজা বলল, তোমার উপর আমি ভরসা করেছি। তবুও আমি যেহেতু রাজা তাই আমার প্রজাদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়েছে। এখন বলো, কি শাস্তি তোমার হওয়া উচিত?
সেনাপতি বলল, যা আপনি শাস্তি দিবেন, তাই মাথা পেতে নিব। আমার মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে।’
রাজা বলল, ‘তোমাকে সেনাপতি থেকে বরখাস্ত করা হল এবং সাধারণ একজন সৈনিক হিসাবে তুমি কয়েক বছর থাকবে। তারপর আপন যোগ্যতায় আবার যদি জায়গা করে নিতে পার তবে এই পদবী আবার ফিরে পাবে। আমি আশা করি সেই যোগত্যা তোমার আছে।’
সেনাপতি বলল, ‘আমি আমার শাস্তি মাথা পেতে নিলাম।’
রাজা বলল,’ দানবের কথা বাদ দিলাম। যারা এই ভোরে রাজ্য আক্রমণ করেছিল। তারা জোয়ার ভাটার কারনে যদি ভোরে না এসে রাতে তীরের কাছে আসতে পারত আর আক্রমন রাতে করত বা এই সময় আমি যদি শিকারে থাকতাম। তবে এতক্ষণে আমার রাজ্য পুড়ে ছাই হয়ে যেত। কি সেনাপতি ছাই হয়ে যেত না।’
সেনাপতি চুপ করে আছে, সে প্রবল ভাবে কাঁপছে।
সেনাপতির দিকে না তাকিয়ে রাজা বলল, ‘এসো আমার সাথে।’
সেনাপতি রাজার পিছু পিছু নেমে গেল নীচে। আর অবাক বিস্ময়ে দেখল উঁচু সরু দালানের নীচে আর একটা সিঁড়ি। তারা সেই সিঁড়ি বেয়ে নামতেই সেনাপতি অবাক বিস্ময়ে দেখল মাটির নীচে বিশাল এক জায়গা, সেখানে শত শত শ্রমিক গোলা বানাচ্ছে। রাজা তাকে একটা গুপ্ত ঘরে প্রবেশ করাল, যেখানে শতশত গোলার মজুদ!
সেনাপতি আবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে রাজার সামনে সে একটা বাচ্চা ছেলে।