সব কিছু চাইতে নেই (রাজা জিনজির’ বই থেকে)
মোঃ নোমান সরকার


রাজা রাজকন্যার সাথে খেলা করছেন। রাজকন্যা খেলা ফেলে বাবার গলা ধরে বলল, বাবা, একটা গল্প বলো না?
বাবা হেসে বলল, কিসের গল্প বলব?’
রাজকন্যা একটু ভেবে বলল, হরিণের গল্প বলতে হবে, বাবা।‘
রাজা খুব খুশি হয়ে রাজকন্যাকে গল্প শোনাতে শুরু করলেন,’এক বনে বাস করত হরিণ আর তার ছানা।

ছানাটিকে হরিণ আদর করে বাবু বলে ডাকত। বাবুটা ছিল অনেক ছোট আর আর খুবই চঞ্চল। মাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না সে। আর মা তো সারাক্ষণ বাবুর চারপাশেই থাকত। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল হারিণের ছোট ছানাটি।
একদিন মায়ের শরীর খারাপ। আর সেই দিনই বাবু মাকে রেখে একটু দূরে গেল বন্ধুদের সাথে খেলতে। বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ডাকালো, ‘মা! ওমা!’
মা হরিণছানার ডাক শুনে বলল, ‘কী হয়েছে আমার মানিক?’
হরিণছানা আদুরে গলায় বলল,’মা আমি বনের রাজাকে দেখব? মা, আমি বনে রাজাকে দেখতে চাই।‘
মা হরিণ তার বাবুর কথা শুনে ভয়ে লাফিয়ে উঠল। ভুলে গেল তার শরীর খারাপের কথা। হরিণ ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমার বাবু! এইসব বলে না! একদম না!’
দিন যায়, মাস যায়, বছরও। শিশু হরিণ বেশ বড় আর লম্বা হয়ে ওঠে। কিন্তু সে বনের রাজাকে দেখতে চাওয়ার কথা কিছুতেই ভোলে না। এ নিয়ে কথা হলেই মা এটা বুঝায় সেটা বুঝায়। কিন্তু কিছুতেই সে ভোলে না।
আরো একটু বড় হবার পর একদিন সে তার মাকে বলল, মা, তুমি যদি বনের রাজাকে দেখাতে নিয়ে না যাও। তবে আমি একা একাই বনের রাজাকে দেখতে চলে যাব।‘
মা অনেক বোঝাল। অনেক কাঁদল মা। কিন্তু বাবু কিছুতেই বুঝল না।
এইটুকু বলার পর রাজা থামলো। তখন রাজকন্যা বাবার গালে হাত রেখে দুশ্চিন্তায় ডুবে গিয়ে বলল, তারপর কি হলো বাবা?’
রাজা আবার বলা শুরু করল,’তারপর নিরুপায় হয়ে মা ঠিক করল, নিয়ে যাবে তার ছানাকে রাজা দেখাতে। তারপর একদিন ভোরে নিজ এলাকা ছেড়ে বের হল তারা দুজনে।
পথে শিয়ালের সাথে দেখা। শিয়াল ওদের দেখে খুব খুশি হয়ে বলল,’বাহ! খুব ভালো লাগছে মা আর বাচ্চাকে একসাথে দেখে। তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?’
মা সব খুলে বলল তাকে।
শিয়ালের মুখে হাসিটা পালিয়ে গেল। শিয়াল গম্ভীর গলায় বলল,’তুমি তোমার সন্তানকে বুঝাও, যে সব চাইতে নেই।‘
মা হরিণ বলল,’আমি নিজেও এভাবে কখনো ভাবিনি।‘
শিয়াল ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি কি তোমার সন্তানকে বলোনি, সব কিছু চাইতে নেই।‘

মা হরিণ বলল, আসলে ও তো অনেক ছোট!’
শিয়াল মন খারাপ করে বলল,’আমি বলছি তোমরা ফিরে যাও।‘
শিয়াল অনেক বুঝাল। তাতে কোনই লাভ হল না। হারিণছানার এক কথা-‘ তবে আমি একা একাই যাব।‘
পথে আরো অনেকের সাথেই দেখা হল। হাতি,মহিষ, গণ্ডার, ভাল্লুক। সবাই তাদের মানা করল। এমনকি খরগোশ পর্যন্ত। কিন্তু হরিণছানার একই কথা, সে রাজাকে দেখতে যাবেই, যাবে।
অবশেষে তারা সেই জায়গাটায় এলো যেখানে বনের রাজা বাস করত। তারা কাছাকাছি এলো ঠিকই কিন্তু নিরাপদ দূরত্ব রেখে রাজাকে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। কিন্তু কোথাও বাঘের দেখা নেই। অন্য কোথায় যেতে পারে, তা নিয়েও ভাবল তারা। এমন সময় মা হরিণ দেখল বাঘটাকে। খুব কছে না হলেও বেশি দূরে নয় বাঘ। কাছেই একটা পাহাড়ী পানির ছড়া থেকে বাঘটা পানি পান করছে। হরিণ বলল,’বাছা আমার! ঐ দেখো আমাদের রাজা পানি পান করছেন। ঐ দেখো’
হরিণছানা সেদিকে লক্ষ করে বনের রাজাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। সে প্রচণ্ড খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল,’কী অদ্ভূত সুন্দর আমাদের রাজা! তাই না মা!’
এই কথা বলেই সে আরো ভালো করে দেখতে দৌড়ে বাঘের কাছাকাছি চলে গেল।
পিছন থেকে মা ডাকছে,’বাবু আমার! এত সামনে যাসনে।‘
ততোক্ষনে বাঘ তাদের কথার শব্দ শুনে ফেলেছিল। বাঘ ফিরে তাকিয়েছে তাদের দিকে। হারিণছানা থামল এবার। তার চোখে কেবলই মুগ্ধতা!
বনের রাজাকে মন ভরে দেখতে দেখতে হরিণছানা শুনতে পেল, বনের রাজা তার দিকে তাকিয়ে অদ্ভূত গলায় একটা চিৎকার দিল। কেন যেন চিৎকারটা তার ভালো লাগল না।
চিৎকার দিবার পরেই দৌড়ে দৌড়ে তার দিকেই আসছে বনের রাজা! কী অদ্ভুত সুন্দর বনের রাজা! কী অদ্ভুত সুন্দরই না তাকে লাগছে। কিন্তু বাঘ যতই কাছে আসতে লাগল ততই বাঘের ভয়ঙ্কর চেহারা আর ক্ষিপ্ত গতিতে তারই দিকে আসার বিষয়টা মিলিয়ে তার ছোট মনে ভয়ের উদ্রেক হতে লাগল। আর তখনই কেন যেন একে একে সবার মানা করার বিষয়টা তার মনে পড়ে যেতে লাগল।
বাঘের ক্ষিপ্ত গতিতে দৌড়ে আসতে দেখে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মা হরিণের কেবল মনে পড়ল শিয়ালের সেই কথাটি, ‘তুমি কি তোমার সন্তানকে বলোনি, সব কিছু চাইতে নেই।‘
3 comments
অসাধারণ আপনার লেখা, লেখা টি পড়ে নিজেকে কল্পনার জগতে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এবং একটা চরম সত্য বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ধন্যবাদ।
অনেক আনন্দ! অনেক আনন্দ যেন ফিরে এলো আপনার মন্তব্য পেয়ে। পাশে থাকবেন। শিশুদের গল্পগুলো পড়ে শুনাবেন,আশা করি। আর তাদের মন্তব্য আমাকে জানাবেন। অনেক শুভেচ্ছা।
আপনার মন্তব্য পেয়ে এত খুশি হয়েছি, অনেক অনেক!!! অনেক ধন্যবাদ। পাশে থাকবেন।