মোঃ নোমান সরকার
সিংহের বাড়ির কাছে এসে শিয়াল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চারদিক ভালো করে দেখল। তারপর আরো সামনে এগিয়ে গিয়ে সিংহকে ডাকল। ‘রাজা মশাই, রাজা মশাই বাড়িতে আছেন?’
সিংহ বের হয়ে এসে খুব মন খারাপ করে বলল, ‘সিংহী মারা গেল। বনের সবাই আসেছিল। একমাত্র তুমি আসনি। একমাত্র তোমাকে দেখতে পাইনি। শিয়াল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’ঐ পাহাড়ের পিছনের বনে গিয়েছিলাম। আজ বনে এসে জানতে পেয়েই দৌড়ে এসেছি। বনের রাণী নেই। বনের রাজাকে কিছু বলার ভাষা নেই। তবুও একটা কথা বলতে চাই। সাহস পাচ্ছি না। যদি সাহস দেন তবে বলি।’
সিংহ খুব শান্ত গলায় বলল, ‘তুমি বলো।’
শিয়াল ধীর গলায় বলল, ‘আপনি কি সম্রাট শাজাহানের নাম শুনেছেন?’
সিংহ বলল, ‘না। আমি সারাদিন আমার প্রজাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তুমি পন্ডিত, বই পড়া নিয়েই থাক। তুমি আমার চেয়ে ভাল জানো।’ শিয়াল মৃদু হাসল। তারপর হাসিটা গোপন করে বলল, ‘সম্রাট শাজাহান হলেন মানুষের মধ্যে এমন একজন রাজা যিনি নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাজমহল বানিয়েছেন। শিয়াল তাজমহলের একটা ছবি বের করে দেখাল। সম্রাট শাজাহান, মমতাজ বেগম আর তাজমহল নিয়ে অনেক অনেক কথা হল।
সিংহ সব শুনে মুদ্ধ হল। সম্রাট শাজাহানের প্রতি তার শ্রদ্ধা প্রতি মুহূর্তেই বাড়তে লাগল। তা বুঝতে পেরে শিয়াল গম্ভীর গলায় তাজমহলের আরো গল্প বলতে লাগল,বলতেই লাগল। সিংহের মনে হতে লাগল সে তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে শিয়াল।
এক সময় সিংহ বলল, ‘তুমি বলছ, আমিও একটা তাজমহল বানাই?’
শিয়াল বলল, ‘মমতাজ থেকে তাজমহল। আর আমরা চাই, সিংহীমহল।’
পরের দিন সাড়া বনে জানিয়ে দেওয়া হল, সিংহীমহল হবে। তাই যার যা আছে তা রাজকোষে জমা দিতে। বনের সব প্রানী অবাক হয়ে সব শুনল সিংহীমহলের কথা। তারা কিছুই বুঝল না, প্রশ্নও করল না, মুখে কিছু বলল না। রাজার আদেশ বলে কথা। বনের যার কাছে যা ছিল, সব দিল। আর সব জমা হতে লাগল রাজকোষে। শিয়াল বনের রাজাকে বোঝাল দিনে সে ব্যস্ত থাকবে সিংহীমহল বানাতে। আর রাতেই হিসাব নিকাশ করবে। তাই রাজকোষের সাথেই শিয়াল তার অর্থভাণ্ডার গড়ে তুলল। রাতের আঁধারে রাজকোষ থেকে তা চলে যায় শিয়ালের ভান্ডারে।
সপ্তাহ যেতে না যেতে আবার হুকুম আসল বনের রাজা থেকে যে, প্রতি মাসেই কর দিতে হবে, যার কাছে যা আছে সব দিতে হবে। বনের প্রাণীরা ভয়ে ভয়ে তাই করতে লাগল।
এভাবেই দিন যায়,মাস যায়, বছর যায়। প্রতি মাসে প্রজাদের সঞ্চয়ে যা আসে তা রাজকোষে জমা দিতে হয়। তারপরেই তা চলে যায় শিয়ালের ভান্ডারে। কেউ টু শব্দ করার সাহস পায় না।
এদিকে সিংহীমহলের কাজ আর শেষ হয় না। শিয়াল বলেছিল তাজমহল বানাতে লেগেছে ২০ বছর। আধুনিক টেকনোলজির কারনে আমাদের লাগবে এক বছর বা তার চেয়েও কম সময় লাগতে পারে। অথচ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে।
সিংহ অস্থির হল। শিয়াল শুরুতে তাকে বলেছিল, এক বছর সময় লাগবে। এখন বলছে দুই বছর! সিংহ প্রচন্ড বিরক্ত হলো, রেগে গেল। প্রজাদের কষ্ট আর সহ্য হচ্ছে না। প্রজারা কেবল দিয়েই যাচ্ছে। আর সব জমা হচ্ছে শিয়ালের ভান্ডারে। এ নিয়ে সিংহ কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। একদিন সিংহং গেল সিংহীমহল দেখতে। শিয়াল সিংহকে নিয়ে গেল বিশাল এক পুকুরের কাছে।
সিংহ বনের সব প্রাণীরা সাথে নিয়ে গিয়েছিল। বনের সব প্রাণীরাদের ডাকতেই তারা চলে এলো পুকুরের কাছে। তারপর তারা পুকুর ঘিরে দাঁড়াল।
শিয়াল বলল, ‘পুকুরের নীচ থেকে উঠানো হচ্ছে সিংহীমহল। আর পুকুরের নীচ থেকে উঠে আসতে লাগবে আরো এক বছর।’
সিংহ বলল, ‘তুমি বলেছিলে এক বছর বা তার চেয়ে কম সময়ে হয়ে যাবে।’
শিয়াল বলল, ‘বলা আর করার মধ্যে অনেক পার্থক্য, রাজা হিসাবে সেটা আপনি আমার চেয়েও ভাল বুঝেন।’
সিংহের মন খারাপ হল। প্রজাদের কথা ভাবল। প্রজাদের সন্তানরা আর কতদিন ঠিক মত খাবার পাবে না, সে কথা ভাবতেই সিংহ বলল,’আপাতত কাজ বন্ধ রাখো। কয়েক বছর যাক, তারপর আবার শুরু করা যাবে।’
শিয়াল হেসে বলল, ‘রাজার যা ইচ্ছা তাই হবে। তবে কাজ কতটুকু হয়েছে তা দেখবেন নিজ চোখে।’
সিংহ গম্ভীর গলায় বলল, তুমি জানো যে আমি সাঁতার জানি না।’
শিয়াল বলল, ‘আমিও তো যাচ্ছি আপনার সাথে। আমাকে বিশ্বাস করুন, আমার সাথে আসুন। যে পুকুরটা দেখছেন এর মধ্যখানে কোন পানি নেই। দেখবার মতন একটা জায়গা বটে। সেই জায়গাটায় তৈরি হচ্ছে সিংহীমহল। সব শ্রমিক পানির নীচে কাজ করছে। অথচ ওদের শরীরে পানি স্পর্শ করছে না। টেকনল্যাজি আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে! আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন।’
শিয়াল বিশাল একটা গাছ পানিতে আগেই ফেলে রেখেছিল। হাতিগুলো দিয়ে বড় একটা গাছ পানিতে ফেলে রেখেছিল।
শিয়াল বলল,’ চলুন আমরা এগিয়ে যাই।’
সিংহ অবিশ্বাস নিয়ে শিয়ালের দিকে তাকাতেই শিয়াল বলল, ‘এই পড়ে থাকা গাছের শেষ পান্তে গেলেই দেখবেন তাজমহলের চেয়েও আরো বেশি সুন্দর হচ্ছে সিংহমহল। দূর থেকে দেখে মনে হবে, পানির নীচে থেকে এই সুন্দর একটা ভবন উঠছে। আর আমি তো আপনাকে বলেছি পুকুরের মধ্য অংশে ওখানে কোন পানি নেই।’ এই কথা বলে শিয়াল আবার তাজমহলের ছবিটা দেখিয়ে বলল, এর চেয়েও অনেক অনেক সুন্দর হবে আমাদের সিংহীমহল।’
সিংহ মুগ্ধ চোখে তাজমহলের ছবিটার দিকে তাকাল। প্রচন্ড আনন্দ তাকে অস্থির করে তুলেছে। মনের আনন্দে পানিতে শুয়ে থাকা গাছটার উপর হেঁটে এগিয়ে গেল। পিছনে শিয়াল। সিংহের মনে হল না, সে সাঁতার জানে না।
শিয়াল সিংহের কাছে এসে বলল, ‘আমরা এমন একটা বিল্ডিং বানাতে যাচ্ছি যা দেখতে মানুষও আসবে। আপনি ভয় পাবেন না। আমার প্রতি বিশ্বাস রাখুন।’
সিংহ আর শিয়াল আরো এগিয়ে যেতেই শিয়াল বলল, আমরা প্রায় চলে এসেছি। আর একটু এগিয়ে গেলেই গাছটা দুলতে থাকবে। আর আস্তে আস্তে নীচে নামতে থাকবে। তখন আপনার মনে হবে আপনি পড়ে যাচ্ছেন। টেকনল্যাজির কি চমক। প্রজারা দেখছে আমাদের, তাই সাহসী রাজা আপনি ভয় পাবেন না। চিৎকার করে লজ্জায় পড়বেন না। ‘
আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে শিয়াল বলল,’এই সিংহীমহলের নীচের অংশের অপূর্ব কারুকাজ আপনি একা একা দেখবেন? আমার মনে হয় সেই ভাল হবে। দেখবেন আর আর মুদ্ধ হতে থাকবেন। সেটাই ভাল হবে।’ বলেই তাজমহলের ছবিটা আবার দেখাল সিংহকে।
সিংহ মুদ্ধ চোখে তাজমহল দেখল আবার। সে যে পানির উপরে একটা ভাসমান গাছের উপর দাঁড়িয়ে সেটা ভুলে যাচ্ছে বারবার।
শিয়াল মহা আনন্দের সাথে বলল,’ আপনার দেখা শেষ হতেই আমাকে ডাকবেন। আমি আপনাকে আবার নিয়ে ফিরে আসব। ‘ এই কথা বলে ধীর পায়ে শিয়াল গাছের ডাল থেকে সরে এলো। ফিরে এল পুকুরের পাড়ে।
কি ঘটছে জানতে প্রাণীরা শিয়ালকে ঘিরে ধরল। শিয়াল ঘাড় ঘুরিয়ে সিংহকে দেখল। সিংহ এখন অনেক দূরে তাকে শুনতে পারবে না। শিয়াল উঁচু গলায় বলল সব প্রাণীদের উদ্দেশে, সিংহীমহল তৈরি হয়ে গেছে পানির নীচে। আমাদের রাজা যাচ্ছে সিংহীমহলে। সেখানেই রাজা থাকবেন। রাজা ফিরবেন এক যুগ পরে। এই এক যুগে তোমাদের আর কর দিতে হবে না। তিনি ফিরে এলে আবার কর নিতে শুরু করবেন। সেই কথা তিনি আমাকে বলে গেছেন।’ শিয়াল দেখল এই কথা শুনতে পেয়ে সব প্রাণী আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারল, করের বোঝা থেকে মুক্তি পেয়ে তারা যেন নিজেদের মুক্ত মনে করছে।
শিয়াল বলল, এই পুকুরের মধ্যখানেই সিংহী মহল আর ওখানে পানি নেই। তোমরা এখন গাছটাকে ঝাঁকাতে শুরু করতেই সিংহ লাফিয়ে নামতে পারবে ওখানে।’
শিয়ালের এই কথা শেষ হতেই সব প্রাণীরা এক যোগে ঝাঁকাতে লাগল পানিতে পড়ে থাকা গাছটা। আর এতেই সিংহ পানিতে পরে গেল।
সিংহীমহল দেখবার নেশায় ডুবে ছিল সিংহ। তাই সে প্রথমে গাছের ঢালের ঝাঁকুনিতে ভয় পায়নি। কিন্তু যখন ঝাঁকি প্রবল হয়ে পানিতে পরে যেতে যেতে সে বিস্মিত হল। টেকনোলজি কিছু নয়, সে তাকিয়ে দেখল তার প্রজারাই গাছের ডাল ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে। যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না বিষয়টি! সে পানিতে পরতেই সবকিছু পরিস্কার বুঝে গেল।
শিয়ালের প্রলোভন দেখানো প্রতিটি কথা তার মনে হল। মনে হল, শিয়ালের কথা শুনে সে সরল ভাবে বিশ্বাস করেছিল। আজ তার পরিনতি ভোগ করতে হচ্ছে। কাউকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করতে নেই। শিয়াল যেভাবে তাকে বোকা বানিয়েছে তেমনি প্রজাদের বোকা বানিয়েছে বলে তারা সবাই মিলে গাছের ঢাল ঝাঁকাচ্ছে। নিজের ভাগ্যের পরিনতি দেখে তার নিজের জন্য দুঃখ হল। দুঃখ হল তার উচ্চাকংখার জন্য প্রজাদের প্রচন্ড কষ্টের কথা ভেবে। চট করে কারো কথায় বিশ্বাসের পরিনতি আর যথেষ্ট অনুসন্ধান না করে সরল ভাবে বিশ্বাস করাটা যে অনেক ভুল আর এত নির্মমই হয়, আজ এই বাস্তবতা বুঝতে পারল। কিন্তু কোন বড় ভুলের দ্বিতীয় সুযোগ হয় না। ইয়া কঠিন পরিনতিই হয়। তাই ভেবে যারা কাজ করে তাদের চট করে কেউ ঠকাতে পারে না।
সিংহ ডুবে যেতে যেতে প্রজাদের প্রতি করের জুলুমের কথা ভেবে চুপ করে রইল। যে বুঝে গেল শিয়াল তাকে হত্যা করতেই এখানে নিয়ে এসেছে। এখন যতই চেঁচাক, কাজ হবে না। এত দূর থেকে কেউ তাকে শুনতে পারবে না। তাই সে চারদিকে তাকিয়ে চিৎকার করল না। সে তাকিয়ে কেবল দেখে নিল তার দুখী প্রজাদের। সাঁতার না জানায় একটু পরেই পানিতেই ডুবে মরে গেল সিংহ।
সিংহ ডুবে যেতেই শিয়াল সবাইকে ডেকে বলল, ‘সিংহ সিংহীমহলের ভিতরে চলে গেছে। এই পুকুরের মধ্যখানে কোন পানি নেই, সেখানেই সিংহীমহলটা।’
পুকুরের চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনের কেউ বিশ্বাস করল , আবার কেউ করল না। কিন্তু প্রতি মাসে করের বোঝা থেকে এক যুগের জন্য মুক্তি পেয়েছে বলে সবাই খুশিতে নাচতে লাগল। নাচতেই লাগল।
শিয়াল তখন খুব জোরে বলল, ‘সিংহ যাবার আগে এক যুগের জন্য আমাকে রাজ্য পরিচয়ালনার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। তোমাদের কি কোন আপত্তি আছে?’
সিংহের অত্যাচার থেকে এক যুগের জন্য মুক্তি পেয়ে সবাই এক সাথে বলে উঠল’ আমাদের কোন আপত্তি নেই। তুমি যদি এক যুগের বেশিও থাক, তাতেও আমাদের আপত্তি নেই।’
সেই থেকে সেই বনের রাজা শিয়াল।