মোঃ নোমান সরকার
খুব বিরক্ত হয়ে ঘাড় বাকিয়ে ছোট কোকিলটা বড় গাছের নিচে নাপিতের লাগানো নতুন দোকানটা দেখলো। সকাল থেকে বসে আছে সে গাছের ডালে। খাবার খুঁজতে বের হয়নি। সকালে এক নাপিত ঠুক ঠুক করে গাছে পেরেক মেরে যখন বড় একটা আয়না ঝুলালো, তা দেখে খুব মন খারাপ হলো তার। গাছের প্রতি মায়া নেই, এ কেমন মানুষ!
মানুষদের অত্যাচারে প্রতিদিন পাখিরা এই গ্রাম ছাড়ছে। গ্রাম থেকে প্রতিদিনই গাছ আর পাখি, দুইটি অদৃশ্য হচ্ছে। কেউ না কেউ গাছ কাটছে । আর সেই সব গাছের পাখিরা শোকে শোকে গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে। পাখিরা একটা মানুষও পেল না যে রুখে দাঁড়ায়, বাঁধা দেয় গাছ কাটায়! গাছ মানুষেরও বন্ধু, সে কথা মানুষ একেবারেই ভুলে গেছে। এই কথা প্রতিদিন আলোচনা হয় পাখিদের ভিতর। কিন্তু কিভাবে সেই সব কথা জানাবে মানুষকে!
পাশের গাছটা গত সপ্তাহে কাটা হয়েছে । কবে কখন এই গাছ কেটে ফেলে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল এই গাছের পাখিরা ! সেই থেকে এক এক করে এই গাছের পাখিরাও চলে গেছে । শুধু ছোট কোকিল যায়নি। বয়সে সে অনেক ছোট ,অনেক বেশি উড়তে হলে কষ্ট হবে। তাই তার মা বলে গেছে , ‘তুমি তো ছোট ,তাই নতুন বাসা খুঁজে বের করার মতন কষ্ট করার তোমার প্রয়োজন নেই। আবার , বয়স এতটাও কম না যে ,আমার সাহায্য তোমার দরকার হবে। তাই তুমি এখানেই থাকো। খুব বেশি একটা দূরে যেও না। কাছাকাছি এলাকা থেকে খাবার সংগ্রহ করো। ভালো আর সুবিধা মতন বাসা পেলে তোমাকে নিয়ে যাব। নিজের দিকে খেয়াল রেখো আর যত্ন করো।’
সেই থেকে ছোট কোকিলটা একা থাকে এই গাছে।
সকাল থেকে সে দেখতে লাগল নাপিতের দোকান সাজানো । লোকজনের আনাগোনা । মন তার খুব খারাপ হয়েছে। তবে গাছ কেটে ফেলার চেয়ে এটা ভালো। এসব ভেবে ভেবে আর এসব শব্দ করে করে নিজেকে এটা সেটা বলে শুনিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই সকাল পেরিয়ে দুপুর হলো। লোকজন একেবারেই কমে গেল। কোকিলটা এক সময় দেখল আশেপাশে নাপিত ছাড়া আর কেউ নেই। এর একটু পরে নাপিতও দোকানের পাশে ঘুমিয়ে গেল। অনেক ভেবে কোকিলটা নিচে নেমে এলো , নাপিতের দোকানে। দোকানের কাছে আসতেই কোকিলের চোখে পড়ল আয়নায়। নিজেকে আয়নায় দেখে ঘাবড়ে গেল ! ভাবল অন্য কোন কোকিল ! আরে এই কোকিলটা , এখানে কখন এলো ! তারপর একটু পরেই বুঝল , এটা সে নিজেই ! কোকিলটা আরেক বার ঘুমন্ত নাপিতকে দেখল। তারপর চারপাশ দেখে আয়নার কাছাকাছি উড়ে এসে বসলো। তারপর নিজেকে দেখ্লো। দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল! আমি এত সুন্দর! এত সুন্দর! আরে কি আশ্চর্য ব্যাপার , আমি এতই সুন্দর !
সেই দিন থেকে ছোট কোকিল রোজ কয়েকবার উড়ে যায় আয়নার কাছ দিয়ে। আর চারপাশে কেউ না থাকলে উড়ে এসে বসে। নিজেকে দেখে। গর্বিত চাহনিতে নিজেকে দেখতেই থাকে। যেন নেশা কাটেনা এমনি ভাবে।
এভাবেই চলল বেশ কয়েকদিন । একদিন কোকিল নিচের এক ডালে বসে আছে। তখন একটা কাক এসে গাছের ডালে বসল। কাককে দেখতেই কোকিল কিছুটা রেগে বলে উঠল ,’একটু দূরে গিয়ে বসো, কি বিচ্ছিরি দেখতে !’
এ কথায় কাকের মন খারাপ হলো। তবে বেশি একটা না। কারন এমন কথা সে আগেও অনেক বার শুনেছে। তার জন্য এটা নতুন কিছু না । কাকটা বিরক্ত হয়ে বলল , ‘ তা ভাই ,তুমি নিজেকে নিশ্চয় অনেক সুন্দর ভাবছ ? বড় কিছু ভেবে নিচ্ছ?’
কোকিল বিস্ময়ের সাথে বলে উঠল , ‘ তুমি কি আমাকে বলছ ! আমাকে ? আমাকে বলছ কি ?’
কাক এদিক সেদিক তাকিয়ে কোকিলের দিকে তাকাল এবার । তারপর চাবিয়ে চাবিয়ে , ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলল,‘এখানে সম্ভবত আর কেউ তো নেই !’
কোকিলের ভীষণ মন খারাপ হল । মন খারাপ গলায় বলল, ‘ব্যাঙ্গ ছলে বললে বলে মনে হলো !’
কাক এবার শান্ত গলায় বলল,‘তোমার কি মনে হয় , আমি মিথ্যে কিছু কি বলেছি? ‘
কোকিল উত্তেজিত গলায় বলল,‘তোমার চোখে কোন অসুখ নেই তো।’
কাক নিরশ গলায় বলল,‘নাতো!’
কোকিল অবাক আর নীচু গলায় বলল,‘তবে তো তুমি আমাকে ভা্লো করে দেখনি ! ‘
‘ হতে পারে আমি তোমাকে ভালো করে দেখিনি । ঠিক আছে ,আমি তোমাকে দেখে নেই তবে। ‘
কোকিল বলল , ‘আমাদের এই এলাকায় যত পাখি ছিল ,আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর! যদিও ইদানিং আমি আমার মা কে ছাড়া চড়ুইদের আর অল্প কিছু পাখি ছাড়া কাউকে দেখিনি। তারপরও আমি নিশ্চিত , আমি দেখতে কল্পনাতীত সুন্দর!’
কাক কোকিলের কথায় অনেক বিরক্ত হলো। তারপরও অনেকখন কাক কোকিলকে দেখতে লাগল।
কাকের কথায় কোকিলের মন অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অসুন্দর কাক কি অদ্ভুত কথা বলে ! সে নাকি সুন্দর না! এবার নিশ্চয় ভালো করে দেখে , ঠিক করে বলবে ! কি অদ্ভুত সুন্দর আমি ! কি অপূর্ব সুন্দর চোখ ! কি অপূর্ব সুন্দর ঠোট ! কি অদ্ভুত সুন্দর তার ডানা ,আর ডানা মেলে ধরা ! নিজেকে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে অজস্রবার।
কাক কয়েক পা কোকিলের সামনে এগিয়ে এলো। কাক আনন্দহীন গলায় বলল , আমি তো বলিনি , তুমি অসুন্দর। কিন্তু তুমি ততো সুন্দর নও। তোমার চেয়ে ঢের সুন্দর পাখিদের আমি দেখি প্রতিদিন। সে কথা যাক, তুমি ছোট একটা পাখি , সুন্দর নিয়ে তুমি এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন ! এতো একটা ফালতু বিষয়! তোমার আচরণ কেমন সুন্দর, সেটাই তো বড় বিষয়।’
কোকিল অস্থির গলায় বলল,‘ কাক তুমি আমাকে খেপাচ্ছ ‘?
কাক অবাক হয়ে বলল,‘কেন কেন, তোমাকে খেপাতে যাব কেন?’
কোকিল রাগ আর অভিমান মিশানো স্বরে বলল ,‘বাহরে ,তুমি যে ভুল বকে যাচ্ছ !’
‘আমি ! আমি ভুল বলে যাচ্ছি মানে কি! আর ভুল বা কি বললাম!
কোকিল ভারী গলায় বলল,‘তুমি আমাকে অপমান করছো! আর আমি তোমাকে শুরুতে বলেছিলাম, একটু দূরে গিয়ে বসো , কি বিচ্ছিরি দেখতে! এটা বলাতে তুমি যা ইচ্ছে তাই বলছ আমাকে?’
কাক গম্ভীর গলায় বলল ,‘ না তো। তবে শব্দ উচ্চারণে সতর্ক থাকা ভালো। বিচ্ছিরি শব্দটার চেয়ে অসুন্দর শব্দটা অনেক শুনতে ভালো লাগে। বিচ্ছিরি শব্দটা বড় শক্ত। আমাকে অসুন্দর বললেই হত।’
‘কাকের কথায় কোকিল লজ্জা পেল । সে অনুতপ্ত গলায় বলল, তোমাকে আঘাত দেবার জন্য আমি দুঃখিত!’
কাকটা এবার হেসে ফেলে বলল , ‘ আরে আমি এ নিয়ে মন খারাপ করিনি। কারন তোমার আচরণ তোমাকে ছোট করবে। তোমার ভুল শব্দ চয়ন তোমার ক্ষতি করবে, আমাকে নয়। তবে এই ভালো যে তুমি বুঝতে পেরেছ, অনুতপ্ত হয়েছ। আচ্ছা এবার বল ,তুমি উড়তে পার কেমন?’
এই দুইদিনে দেখলাম ভালো উড়তে পারছি। কেন বলত?’
কাক বলল, ‘ছোটদের বেশি দূরে যেতে নাই । তবুও তুমি আমার সাথে যেতে পার। যেখানে গেলে তোমার সুন্দর আর অসুন্দর নিয়ে ভুল টা ভাঙ্গবে।’
কোকিল বিস্ময়ের সাথে বলল , ‘সত্যি কি তুমি বলতে চাচ্ছ ,আমি তেমন সুন্দর নই !’
কাক হেসে বলল ,আমি উড়ে যাচ্ছিলাম। তোমার অসম্ভব সুন্দর গলার স্বর শুনে এই ডালে বসেছিলাম। তুমি সুন্দর এবং প্রত্যেকেই সুন্দর।’
একটু থামল কাক। যেন কিসব ভাবছে। তারপর তেমনি হেসে বলল, চল , এই দুই গ্রাম পরে একটা জঙ্গল আছে। সেখানে চল যাই। সেখানে অনেক অনেক পাখিরা থাকে। এখানে নিরাপদ না। এই জায়গাটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। আর মানুষের ভিতরে মায়া দয়া আগের মতন নেই। যার মায়া নেই, তার ভিতরটা শূন্য, কেবল সে বুঝতে পারে না। মানুষেরা ভয়ানক ভাবে বদলে যাচ্ছে। আহ! কেউ যদি তাদের বুঝাতে পারত!’
কোকিল বলল, তুমি তো ভারী সুন্দর করে কথা বলতে জানো!’
কাক বলল, একদিন তুমিও পারবে। আগে বড় হও। আর মায়া দিয়ে দেখ চারদিক। দেখবে সব আপন। সবই তোমার নিজের। মায়া তমার ভিতর বাসা বাঁধলেই তুমি যত্ন নিতে শিখবে, আদর করতে শিখবে, ভালোবাসতে শিখবে। আচ্ছা এবার আমার যাবার পালা। যদি সাহস কর ,তবে আমার পিছু নিতে পারো। তবে আমি তোমাকে জোর করব না। কারন জোর করে নিলে, পরে তুমি আমাকে ভুল বুঝতে পা্রো। কিছুখন ভেবে তারপর ঠিক করো বা আমি আগামী কাল আসব। তখন ঠিক করে নিও কি করবে।’
বেশ কিছুক্ষণ পাশে থেকে কাক উড়ে গেল। কোকিল কয়েক মুহূর্ত কিসব ভাবলো। তারপর উড়ে গেল কাকের পিছু পিছু।
তখন বিকাল । যখন ওরা জঙ্গলে পৌছালো। কোকিল বিস্ময়ে আর মুগ্ধতার সাথে দেখল, কত বিচিত্র সব ছোট বড় পাখি ! কি অবিশ্বাস্য সুন্দর সুন্দর রং তাদের ! কি অপূর্ব সুন্দর সুন্দর সেই সব পাখি ! আর নানান ধরনের ছোট বড় অসংখ্য গাছ । হতভাগা দুষ্ট মানুষ কি জানে এই গাছের কথা ! জানলে তো সর্বনাশ ! এখানেও তারা পৌছে যাবে, কেটে ফেলব সব গাছ! কোকিল ভয় পেল। তবে চারদিকে তাকাতে তাকাতে মানুষের কথা ভুলে যেতে লাগল। যেন মানুষ নিয়ে ভাবনাটা ভাবল বটে তবে জঙ্গলের সৌন্দর্য ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত পরেই।
সন্ধ্যা নেমে এলো। জঙ্গলের একটা গাছে কোকিল আর কাক আশ্রয় নিয়েছে । অচেনা জায়গার অন্ধকার কোকিলকে ভীত করতে পারেনি । তার মাথায় অনেক প্রশ্ন আর বিস্ময় নড়েচড়ে বেড়াতে লাগলো!
কোকিল চিন্তার জগতে ডুবে গেল। ভাবতে ভাবতে সে যেন হঠাৎ করে আবিস্কার করল, আমি সুন্দর বা কম সুন্দর, এসব ভাবনায় কি আসে যায় ! আমি তো আমাকে বানাইনি ! যা কিছু আমার বলে এতদিন ভেবেছি তাতো আসলে আমার নয়। আমার তো নয়! কেবল আমার কথা , কাজ আর আচরণ ছাড়া ! কাক দেখতে কতইনা অসুন্দর । অথচ সুন্দর করে কথা বলে। তবে তো সে ভালো। সে ভালো আমার চেয়ে । কারন আমি অসুন্দর করে ভাবি। বাজে বাজে শব্দে কথা বলি বা রেগে কথা বলি!
অন্ধকারে কাক প্রশ্ন করল , ‘ তুমি কি ভয় পাচ্ছ ?’
কোকিল অন্ধকারে কাক কে দেখতে পেল না । সে মৃদু হেসে বলল , ‘ না । ভয় কিসের! আমি ভাবছি ,আমি কি বোকা ছিলাম যে নিজেকে নিয়েই ভাবতে শিখেছিলাম। আমি আজ জেনেছি , নিজের দেখার মধ্যে বড় কোন আনন্দ নেই । নিজেরটা বড় করে ভাবার মধ্যে বড় কোন আনন্দ নেই। আনন্দ আসলে জানার মধ্যে, শিখার মধ্যে।’
কাক হেসে বলল , বাহ্যিক সৌন্দর্য হচ্ছে সৃষ্টকর্তার দান । আর অন্তরের সৌন্দর্য নিজের! বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে বড়াই করার কিছু নেই। এই যে তুমি সুন্দর সুন্দর পাখি দেখছ, তার মধ্যে বয়স্ক পাখিগুলোও দেখেছ। বয়স তাদের সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে। এক সময় তোমার আমার সৌন্দর্যও কেড়ে নিবে। কিন্তু মনের যে শিক্ষা বা জ্ঞান তা কেউই কেড়ে নিতে পারবে না। একটু থমে কাক বলল , ‘এই যে বিশাল পৃথিবী তা আমাদের সব সময় জানায় , এসো , দেখো ! উপভোগ করো এই পৃথিবীর যত দুঃখ আর আনন্দগুলো তাই নিজের কথা নিয়ে পড়ে না থেকে উপরের আকাশটাকে মন ভরে দেখো!’