মোঃ নোমান সরকার
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা , আমাদের দেশে এক রাজা ছিল। তার অনেকগুলো মন্ত্রী ছিল। এর মধ্যে তিনি একজন মন্ত্রীকে খুবই পছন্দ করতেন। আর যে কোন বিষয় তার সাথে আলোচনা করে নিতেন। তিনি ছিলেন খাদ্য মন্ত্রী।
এক দিন সকালে খাদ্য মন্ত্রী তার প্রাসাদ থেকে বের হতে যাবে তখন মন্ত্রীর মা তার পথ আগলে দাঁড়ালেন। মন্ত্রী মাকে দরজায় এভাবে দাঁড়াতে দেখে অবাক। মা বলল ‘খোকা আজ তোর রাজদরবারে যাওয়া হবে না।‘
মন্ত্রী বলল,’মা কি বলছ ? রাজ দরবারে না গেলে কি চলবে! আমি মন্ত্রী না।‘
মা বলল , তা মন্ত্রী ! মায়ের মুখে মুখে কথা বলা খুব দেখি শিখেছ ?’
মন্ত্রী হাসতে হাসতে বলল ,’ মা তা কি আমি পারি !’
মা বলল ,আমি কখন কি তোকে বাধা দিয়েছি ? আজ দিচ্ছি । কারন আছে। আমি স্বপ্নে দেখেছি ,রাজা তোকে অনেক বকছে । তারপর দেখি রাজা তোকে মন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করছে। তারপর দেখি রাজা তোকে বন্দী করে রাজ দরবারে নিয়ে গেছে। আমার অনেক খারাপ লেগেছে স্বপ্ন দেখে। প্রতিদিনই তো রাজদরবারে যাস ,আমি তোকে কখনো কোন বিষয়ে বাঁধা দেইনি খোকা। বাবা , আজ তুই ঘরে থাক।‘
মন্ত্রী জানে, স্বপ্ন তো নিছক স্বপ্ন । তবুও মন্ত্রী মায়ের কথার উপর একটা কোন কথা বলল না। মায়ের সাথে অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলে ঘরে চলে এলো। খুব চিন্তায় পরে গেল। তার কখনও এমন হয়নি যে সে রাজ দরবারে যায়নি। ভাবতে ভাবতে সে বারেন্দায় এলো। তারপর সে একটা সুকানো গাছের পাতায় ময়ূরের পালক কালিতে ভিজিয়ে রাজাকে চিঠি লিখে জানাল যে আজ সে অসুস্থ তাই সে আজ রাজ দরবারে আসবে না। এ টুকু লিখে কবুতরের পায়ে বেঁধে কবুতর উড়িয়ে দিল।
রাজা সেই চিঠি পেয়ে খুব বিচলিত হলেন। তিনি রাজ কবিরাজ কে ডেকে পাঠালেন । আর মন্ত্রী বাড়িতে মন্ত্রীকে নিয়ে আসার জন্য বিশেষ পালকি পাঠালেন।
পালকি খালি এলো। মন্ত্রী এতই আসুস্থ যে রাজ পালকিতেও আসতে পারবেন না। সেটা মন্ত্রী লিখে জানিয়েছেন।
রাজা রাজ দরবার ঘেষে থাকা পাঠাগার প্রাসাদে এলেন। চিঠিটার দিকে তিনি অনেক সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। আগের চিঠি আর পরের চিঠি ভাল ভাবে দেখতে লাগলেন। এত ধীর ভাবে লেখা দেখে রাজার সন্দেহ হল । তাকে লেখা কয়েক বছরের মধ্যে খাদ্য মন্ত্রীর সব চিঠি বের করে আনতে আদেশ দিলেন । তারপর নিজেই ডুবে গেলেন লেখার মধ্যে যেন । মন্ত্রী এর মধ্যে যতবার অসুস্থ হয়েছে সেই সময়ের চিঠি আর তার অক্ষরের মধ্যে যেন ডুবে গেলেন। প্রত্যেক অক্ষর ভাল করে দেখে বের করলেন কোনটা তাড়াহুড়া করে লেখা। কোনটা অস্থির ভাবে লেখা। আর কোনটা অসুস্থ থাকা কালীন লেখা। সব চিঠি অনেক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে অনেক খন পর রাজা চিৎকার করে বলল রাজ পালকিকে আবার পাঠাও ,জানাও রাজার আদেশ ,মন্ত্রীকে আসতেই হবে।
মন্ত্রী তবুও এল না!
রাজা হো হো করে হাসতে লাগল। হাসিতে সাড়া প্রাসাদ যেন কাঁপতে লাগল। কাঁপতে লাগল রাজ দরবারে থাকা সকল মন্ত্রী আর রাজ কর্মচারী। রাজা হাসে আর হাসে। তারপর গম্ভীর ভাবে আদেশ দিলেন ,’সিপাহী তুমি নিজে যাবে মন্ত্রীকে বন্দি করে নিয়ে আসবে।‘
খাদ্য মন্ত্রীকে বন্দী করার সময় তার মা অনেক কাঁদলেন আর বললেন ,আমি এই স্বপ্নই দেখেছিলাম। আমাকে আমার সন্তানের সাথে নিয়ে চল।‘
কিন্তু কেউ মাকে নিলো না।
বিকাল ফুরিয়েছে তখন। রাজ দরবারে সকাল থেকে কেউ নড়ারও সাহস পায়নি ,শব্দ করা তো দুরের ব্যাপার ! মন্ত্রীকে বন্দী অবস্থায় হাজির করা হল।
রাজা গম্ভীর গলায় বলল ,’আসামীর কোন কথা থাকলে সে বলতে পারে।‘
মন্ত্রী সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফে্লল , মায়ের আদেশ পালন করতে গিয়ে জীবন গেলেও সে তার জন্য প্রস্তুত। তিনি সব খুলে বললেন।
এ কথা শুনে রাজা আগের মতন হাসতে লাগলো। আর সবাই ভয়ে কাঁপতে লাগলো। রাজা হঠাৎ করে হাসি থামিয়ে রাগী গলায় বলল ,’মায়ের আদেশ যদি রাজ্যের বিরুদ্ধে হয় ,তখন কি করবে?’
আমার জীবন আপনার আর রাজ্যের জন্য কোরবানী হোক। জাঁহাপনা আপনি আমার মায়ের ত্যাগের কথা জানেন। মা রাজ্যের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না।
রাজা জোরে চিৎকার দিয়ে বলল ,রাজ কর্মচারীদের সবার খবর আমি রাখি । আমি তোমার কথা জানতে চেয়েছি ?”
আমার জীবন আপনার আর এ রাজ্যের জন্য কোরবানী হোক। যদি এমন আদেশ আসে তবে মাকে বুঝাব , মা অবশ্যই বুঝবে । আর যদি না বুঝে তবে আমি মাকে খুশি করা থেকে নিজেকে থামাব। তবুও রাজা আর রাজ্যের বিরুদ্ধ্বে যাব না।‘
রাজা আবার আট্ট হাসিতে ভেসে গেলেন। তিনি তরবারি বের করলেন। রাজা থেমে প্রশ্ন করলেন ,রাজার আদেশ অমন্য তো করে ফেলেছ, এখন কেমন বিচার আশা কর?’
মন্ত্রী ভয়ে ভয়ে বলল , ‘আমি রাজার ডাকে সাড়া দেইনি। আমি অপরাধী । এখন রাজা যদি দয়া করেন।‘
রাজা তরবারি হাতে নেমে এল সিংহাসন থেকে । অতান্ত ধারাল তরবারি দিয়ে মন্ত্রীর কাছে এসে তার বাঁধনে স্পর্শ করতেই তা কেটে গেল। সবাই আবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। সবাই ধরেই নিয়েছে আজ মন্ত্রীর জীবনটা যাবে। রাজা আনন্দের হাসি হাসতেই রাজ দরবারে প্রত্যেকে আনন্দে কেঁদে ফেললো। জীবন ফিরে পাওয়ার চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। জীবনের চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। রাজদরবারের প্রতেকেই অনুভব করল, জীবন ফিরে পাবার স্বাদ। সেই সকাল থেকে কি ঘটবে তা নিয়ে প্রচন্ড ভয়ে ছিলেন প্রত্যকেই। কারন একটি মৃত্যু দিয়ে কোন গল্পই শেষ হয় না।
রাজা বলল ,নিয়ে এসো মাকে । আমার নিজের মাকে দেখিনা বহুকাল। মা তো চলে গেছে না ফিরার দেশে, আমি কতদিন মাকে দেখিনা।‘
তারপর মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল ,যে তার জীবনের চেয়ে মাকে ভালবাসে তাকে রাজা কি কোন শাস্তি দিতে পারে?’
মন্ত্রী আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে রাজাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। সাহসে কুলালো না। কিন্তু রাজা যেন তা অনুভব করলেন। তাকে জড়িয়ে ধরলেন,যেন অনেক আদরে রাজা তা করলেন!