দৈত্য আর রাজকন্যা (পর্ব–১)
মোঃ নোমান সরকার
অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক বিশাল নির্জন দ্বীপে বাস করত একটা দৈত্য। বিশাল লম্বা সে। যেন সে আমাদের একটা বড় আর উঁচু গাছের কাছাকাছি লম্বা। দেখতে অসুন্দর হলে কি হবে , তার হৃদয় ছিল অনেক অনেক ভালো, অনেক বড় । বিনা কারনে দ্বীপের কোন পশুকে হত্যা করত না। কারো সাথে ঝগড়া নেই তার। সারাদিন সমুদ্র, দ্বীপের নদী, পুকুর থেকে মাছ ধরে মজা করে করে খাওয়াই যেন তার পছন্দের কাজ। আর বিশাল নির্জন দ্বীপটা ঘুরে বেড়াতেই তার ভালো লাগত। দ্বীপের ছোট বড় পাহাড়ের আছে অনেক। দৈত্য আশে পাশে প্রতিদিন নতুন নতুন জায়গা ভ্রমনের করত। এটাই সবচেয়ে বড় শখ ছিল তার। এভাবেই দিন কাটে তার।
একদিন হল কি, বিশাল নির্জন দ্বীপটায় সে ভ্রমণে বের হতে গিয়ে অনেক দূরে চলে এসেছিল। কয়ে দিনের পথ পাড়ি দিয়ে দ্বীপের শেষ দিকে যেখানে সমুদ্রের তীর আছে সেই জায়গায় ঘুরতে গেল। সমূদ্রে সাতার কেটে ডুব দিয়ে অনেক নীচে গিয়ে বড় মাছদের সাথে ঘুরে বেড়াতে লাগল। বেড়াতেই যেন তার সব আনন্দ। কিন্তু পরের দিনই ঝড় শুরু হল, অনেক বড় ঝড়। ঝড়ের দিনে দৈত্য সমূদ্রে নামার সাহস করল না। ঝড় থেকে বাঁচার জন্য সে পাহাড়ের অনেক নীচে গিয়ে বসে থাকল। যখন তার মনে হল ঝড় থেমে গেছে সে দৌড়ে এল সমুদ্রের তীরে। সে আগেও দেখেছে ঝড় হলে সমুদ্রের তীরে নতুন অজনা অচেনা কিছু না কিছু পাওয়া যায়। সে তীর ধরে হাঁটতে লাগল, হাঁটতেই লাগল। বেলা প্রায় শেষ এমন সময় সে কুড়িয়ে পেল একটা ছোট মেয়েকে। সে অনেকক্ষণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। সে বুঝল মেয়েটি মরেনি, বেঁচে আছে। তার আনন্দের সীমা রইল না। সে ছোট মেয়েকে উঠাল তার হাতের তালুতে। তারপর সে তাকে হাতের তালুতে করে নিয়ে ছুটল। তাকে কয়েকদিনের পথ পাড়ি দিতে হবে, তবেই সে ফিরে যাবে তার গুহায়, তার নিজ বাড়িতে ।
এর আগে এমনি ভাবে সে একবার মানুষ কুঁড়িয়ে পেয়েছিল। তার নাম ছিল জন। সেও অনেক অনেক আগের কথা। বহুকাল সেই মানুষটা ছিল তার সাথে ভাল বন্ধুত্ব হয়েছিল। ঝড়ের পরেই এ দ্বীপে সমুদ্রের তীরে তাকেও ঘুমান্ত অবস্থায় পেয়েছিল সে। কিন্তু সে ছিল এই মেয়েটার তুলনায় অনেক লম্বা। দৈত্যটা তাকে নিয়ে এসে আদর যত্ন করে রেখেছিল। জন তাকে শিখিয়েছিল ভাষা। ভাষা শিখার পর অন্য রকম হয়ে উঠেছিল দৈত্যের জীবন। সে তেমন কথা বলতে না পারলেও কথা বুঝার বিষয়টি শিখেছিল। নতুন নতুন শব্দ শিখায় আর জানায় সে যেন নিজেকে প্রকাশ করতে শিখেছিল।
তার কথা বলার উচ্চারণ ছিল ভাঙ্গা ভাঙ্গা, জড়িয়ে যাওয়ার মতনই। সে কথা বললেই তখন জন নামের লম্বা মানুষটি কেবলই হাসত। জন অনেক গল্প করত বা সারাক্ষণ কথা বলত। দৈত্য মুগ্ধ হয়ে শুনত। দৈত্য প্রতিদিন শিখে নিত নতুন নতুন শব্দ আর নতুন নতুন বিষয়। কিন্তু জন তার কাছে শেষ পর্যন্ত থাকেনি। হঠাত করে একদিন পালিয়ে গিয়েছিল বা এমন হতে পারে সে যে নৌকা বানিয়েছিল তা ডুবে গিয়েছিল।
দৈত্য যখন তাকে খুজে পেল তখন সে দেখল, সমুদ্রে জন নৌকায় করে যাচ্ছে। দৈত্য ক্রমাগত ডাকছিল। কিন্তু জন ফিরে আসেনি। জনের কাছে নৌকার গল্প অনেক শুনেছিল দৈত্য, তাই সে বুঝেছিল সাহসী মানুষ জন ফিরে আসবে না। নৌকায় করে যখন অনেক দূরে চলে গেল। দৈত্য সমুদ্রে সাতার কেটে তার কাছে পৌঁছানোর অনেক চেষ্টা করেছিল আর কেঁদে কেঁদে ডাকছিল। কিন্তু সে ফিরেনি। নৌকা এক সময় দৈত্যের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গিয়েছিল। বহু দিন দৈত্য মন খারাপ করে কেবলই সাড়া দ্বীপ ঘুরে বের বেড়িয়েছে। এই দ্বীপের সব জায়গায় জনকে সে নিয়ে গেছে। কেন সে বলে গেল না? কেন? বলে গেলে কি হত! বলে গেলে কি আটকে রাখত? খুব কষ্ট পেয়েছিল দৈত্যটা।
জনের কাছে দৈত্য শিখেছে আগুনে ঝলসিয়ে মাছ খাওয়া। জেনেছে কি ধরনের ফল মানুষ পছন্দ করে। আরো কত কি! তাই সে ছোট মেয়েটার জন্য ফলমূল নিয়ে এল, ঝলসান মাছ একটা কলা পাতায় করে ঠেলে দিল গুহায়। ছোট মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছিল আরো দুই দিন আগে। দৈত্য পথে খাবার রেখে দিয়ে দূরে চলে যেত। সে আড়াল থেকে দেখে ছিল, মেয়েকে কাউকে খুঁজছে। খুঁজে কে তাকে খাবার দিয়ে যায়, তাকে দেখতে চাইছিল, সম্ভবত। সারাদিনের পর যখন মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যেত, তখন নিরবে দৈত্যটা বের হত দেখতে আসত মেয়েটিকে। দেখত মেয়েটা খাবারের সবটুকু খেয়েছে কিনা। তারপর ঘুমন্ত মেয়েটাকে হাতের তালুতে উঠিয়ে নিয়ে ছুটত নিজের গুহার দিকে। মেয়েটার যেন ঘুম না ভাঙ্গে এভাবেই সে তাকে হাতে নিত, এই কৌশলটা শিখে ছিল জনের কাছে। এভাবেই দুইদিন পরে সে গুহায় পৌছে ছিল।
দৈত্য বুঝে তাকে হঠাত করে দেখলে ছোট মেয়েটা ভয় পেয়ে যাবে। তার বিকট চেহারার কোন মানূষের মিল নেই আর জন বলেছিল এত বড় দেখতে কোন মানুষই নাকি নেই দুনিয়ায়। তাই তাকে দেখে ভয় পাবে ছোট মেয়েটি। এই ভয়ে সে দূরে দূরেই থাকে।
গুহায় কয়েকদিন পরে দিনে দৈত্য যখন খাবার হাতে এল তখন দৈত্যটাকে মেয়েটি দেখে ফেলল। মেয়েটির যে ঘুম ভেঙ্গেছে বা সে গুহার বাইরে এসেছে দৈত্য সেটা বুঝতেই পারেনি। দেখতেই মেয়েটি প্রচণ্ড জোরে ”অ্যাঁ অ্যাঁ ”,করে এমন চিৎকার দিল যে দৈত্যই ভয়ে বনে পালিয়ে গেল। দৈত্যকে দেখে মেয়েটি যে ভয় পেয়েছে, এর জন্য সে লজ্জায় পড়ে গেল। সে যেন ভয় পেয়েছে এমনি ভাবে ভয়ে ছুটল বনের দিকে। অনেক খন পরে দৈত্যটা আবার এসে উঁকি দিল কিন্তু সেই একই গলায় চীৎকার ”অ্যাঁ অ্যাঁ! দৈত্য আবার পালিয়ে গেল বনে ।
কুঁড়িয়ে পাওয়া জন তাকে প্রথমে দেখে ভয় পেয়েছিল, পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। দৈত্য বাধা দেয়নি। কিন্তু মেয়েটি পালিয়ে যেতেও যাচ্ছে না। দৈত্য ভেবে পেল না সে কি করবে।
লাগল । যেন কিছুতেই সে হাসি থামবে না ।
দৈত্য নিজ মনে বার বার বলেছে ,” আমি বন্ধু ,আমি বন্ধু। বন্ধু শব্দটা কি এটা জানতে পেরেছিল ভাষা শিখার পরে। সেটা হয়েছিল অনেক অনেক দিন পর। একটা একটা করে শব্দ শিখেছিল। জনের ছিল অসম্ভব ধরয্য।
পরের দিন সকালে খাবার দিয়ে দূরে এসে খুবই নরম আর সুরেলা গলায় দৈত্য বলতে লাগল , ” আমি বন্ধু ,আমি বন্ধু ”। অনেক বার এই কথা বলে সে আবার বনে পালিয়ে গেল।
পরের দিন গুহায় ফিরে দূর থেকে বলতে লাগল, আমি বন্ধু আমি বন্ধু। সেই কথা কাজ হল। সে দূর থেকে দেখল মেয়েটা অবাক হয়ে উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে । নরম গলার কথা বলা মনে হয় মেয়েটার পছন্দ হয়েছে । দৈত্য কলা পাতায় করে মাছ আর ফলমূল দিয়ে বনে পালিয়ে গেল । এভাবে একদিন যায় ,দুই দিন যায় । কয়েকদিন যেতে না যেতে মেয়েটার সাথে দৈত্যের বন্ধুত্ব হয়ে গেল । দৈত্য জানল , এই হচ্ছে রাজার মেয়ে ,রাজকুমারী ননী । দৈত্য রাজকুমারীর দিকে আঙ্গুল তুলে বারবার বলতে লাগল ‘ননী, ননী।‘
রাজকুমারী ননী দৈত্যকে বলেছে, সমুদ্র ভ্রমণে এসে ঝড়ে পরে জাহাজ ডুবে গেছে। সে ভেসে এসেছে এই দ্বীপে।
দৈত্য তাকে কাঁধে করে সাড়া বন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল । এখানে যায় ওখানে যায় । এখানে যায় ,সেখানে যায় । বড় বড় গাছের সমান হওয়ায় এ ফল খায় ,ও ফল খায়। তার কেবলই জনের কথা মনে পড়ে।
একদিন দুপুরে দৈত্য গেছে সমুদ্রে । এসে দেখে রাজকুমারী নেই । নেই নেই কোথাও নেই । দৈত্যটা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল । কাঁদতে কাঁদতে কয়েকদিন কেটে গেল । সে কাঁদে আর সারা বনে রাজকুমারীকে খুঁজে বেড়ায় । একজায়গা শতবার করে খুঁজে যেতে লাগল ।
পরের দিন ভোরে সে ঘুমতে উঠতে গিয়ে দেখল তার হাত , পা ,মাথা গাছের শিকড় দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করছে কেউ। সে হুলুংকার দিল । সে দেখল কয়েকজন মানুষ। দৈত্য গাছের শিকড়গুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলল। তখন লম্বা করে একজন মানুষ এগিয়ে এল। দৈত্যের মনে হল এটা জন। জনের মতনই দেখতে একজন মানুষ এগিয়ে এসে বলল ,” দৈত্যে আমরা তোমাকে বন্দী করেছি। তুমি নাড়াচড়া বন্ধ কর। তুমি নাকি কথা বলতে পার ! আমি জন্মের পর এমন অদ্ভূত কথা কখনো শুনিনি । তুমি কিছু বল ,আমরা একটু শুনি । বল বল বল । কিছু একটা বল ”।
দৈত্য অবাক হয়ে খেয়াল করল আসলেই মানুষটা দেখতে অনেকটাই জনের মতন। তার মনের মধ্যে জনকে কুঁড়িয়ে পাওয়া আর জনের চলে যাওয়ার স্মৃতি ভেসে এল। তখনই তার ছোট মেয়েটার কথা মনে হল। সে আবার হুলংকার দিল।
লোকটা বলল ,” আমি সেনাপতি বলছি । চেঁচামেচি করে লাভ হবে না । তুমি রাজবন্দী ” । ঠিক তখনই দৈত্য উঠে বসল।
সেনাপতি চেচিয়ে বলল ,”আরে আরে ! এটা কি হল ”?
সেনাপতির সাথে থাকা সৈন্যরা যে যেদিকে পারল পালাতে চাইল ।
দৈত্যটা সেই সুযোগ না দিয়ে অনেকগুলো সৈন্যসহ সেনাপতিকে দুই হাতে চেপে ধরল ।
সেনাপতি তেমনি চেঁচাতে চেঁচাতে বলল, ”শুনেছিলাম তুমি নাকি খুব ভালো । এখন তো তা মনে হচ্ছে না ”!
দৈত্য আরো কয়েকজন সৈন্যকে পা দিয়ে আটকালো ।
দৈত্য বলল, ” কে বলল? ”
সেনাপতি বলল, ”রাজকন্যা ”।
সেই কথা শুনা মাত্রই দৈত্যের চোখে বড় বড় হয়ে গেল। দৈত্যে তার হাতের মুঠোর ভিতর থাকা অন্য সৈন্যদের ছেড়ে দিল, কেবল সেনাপতি কে রাখল । সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বলল ,” নাম ? জন ?’
সেনাপতি বলল, আমার নাম এরিক। ‘
দৈত্য বলল, ননী? দাও? । বলে নিজের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল।
সেনাপতি সাহস করে জোর গলায় হাসল। বলল, সেটা হতে পারে না। তুমি একটা ভয়ানক দৈত্য।
দৈত্য বলল, ‘ননী? দাও?’ হাত দিয়ে ছোট একটা কিছু বুঝাল। সেনাপতি বুঝল ,দৈত্য রাজকুমারীর কথা বুঝাচ্ছে। সেনাপতি নিজেকে দৈত্যের হাতের মুঠ থেকে ছাড়িয়ে নিবার আপ্রান চেষ্টা করতে করতে বলল , ” তুমি দুষ্ট দৈত্য ! তুমি আমাদের রাজকন্যাকে এখানে বন্দী করে রেখেছিলে । এবার তোমাকে আমরা তার সাজা দিব । তোমাকে মজা দেখাব । সেই জন্য আমরা এখানে এসেছি। তোমাকে যে কোন উপায় বন্দী করব ”।
দৈত্য আরেক হাত নিজ গালে রেখে বলল ,” আচ্ছা ”?
সেনাপতি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, দৈত্যটা আচ্ছা শব্দটা কত সুন্দর করেই না বলল। তারপরে অবিকল মানুষের মতন অবাক হবার ভান করে গালে হাত রাখল। মানুষের কাছে মানুষের মতন করে কত সুন্দর করে না শিখেছে!
সেনাপতির ইচ্ছে করছে তরবারি দিয়ে দৈত্যের লম্বা নাকটা কেটে দিতে । কিন্তু তরবারি আটকে আছে ,বের করার কোন উপায় নেই। সেনাপতি দৈত্যের গালে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে রেগে চিৎকার করে বলতে লাগল ,” আমাদের রাজকন্যা মানা করেছে , তা না হলে সেদিনই তোমাকে বাতাস বানিয়ে ফেলতাম। বাতাস বানিয়ে ফেলার মানে বুঝ ? ,তুমি কি করেই বা বুঝবে ”! দৈত্য না সূচক মাথা নাড়াল ।
দৈত্য বলল ,” ননী? দাও“?
সেদিন ঝড়ে জাহাজ উল্টে গেলে মোটামুটি সবাই প্রায় বেঁচে গেলেও রাজকন্যাকে তারা খুজে পাচ্ছিল না। প্রায় নয় দিন পরে তারা রাজকন্যকে খুজে পেয়েছিল সাথে এই দৈত্যটাকে। রাজকন্যা কাঁধে বসা ছিল এই দৈত্যের। কাধে বসে রাজকন্যা ফল খাচ্ছিল। সবাই তা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের রাজকন্যাকে একটা দুষ্ট দৈত্য থেকে উদ্ধার করতে পেরেছি।
দৈত্য আবার চিৎকার করে বলল ,” ননী? দাও“?
সেনাপতি কাঁদবে না হাসবে বুঝতে পারছে না ।
সেনাপতি বলল, আমরা দেশে ফিরে গিয়ে তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করব। তারপর বড় দল নিয়ে এসে তোমাকে বন্দী করব।
দৈত্য বিরক্ত হয়ে সেনাপতির গলা নকল করে বলল ,” নালিশ। নালিশ?
সেনাপতি দৈত্যের হাতের মুঠা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিবার আবার চেষ্টা করল । তারপর কড়া গলায় বলল,” তুমি আমাদের রাজকন্যাকে বন্দি করে রেখেছে । আমাদের রাজকন্যাকে তুমি কাধে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছ ? যদি রাজকন্যা উচু কাধ থেকে যদি পরে যেত ? তাহলে কি হত ? তুমি জান রাজা তোমাকে সিদ্ধ ডিম বানাত ? সিদ্ধ ডিম তো আবার তুমি চিনো না ,নাকি চিনো ?
দৈত্য মাথা দুলিয়ে না সূচক উত্তর দিল । সেনাপতি মাথা ডানে আর বায়ে নিয়ে চোখ উপরে নিয়ে কি যেন ভাবল । তারপর চঞ্চল গলায় বলল ,” তুমি রাজকন্যাকে মাছের ফ্রাই খাইয়েছ না ”? দৈত্য মাথা দুলিয়ে হ্যা সূচক উত্তর দিল।
সেনাপতি বলল ,” রাজকন্যার কিছু হলে রাজা তোমাকে মাছের ফ্রাই এর মতন করে তোমাকে ভাঁজা ভাঁজা করে বানাত ”।
দৈত্য সে কথা শুনে হা হা হা করে হাসতে খুব মজার কথা বলেছি । শুন দৈত্য । আমি রাজার সেনাপতি । রাজার লোক । আমাদের দৈত্য দানব ,রাক্ষস মেরে অভ্যাস আছে । তোমার চেয়ে বড় বড় দৈত্যের সাথে আমাদের অনেক অনেক যুদ্ধ হয়েছে । তুমি নিজেও জানো না তুমি কত কত বড় বিপদে আছ ?
সেনাপতি বলেই চলছে ,” তবে দৈত্য কথা বলতে জানে তা আগে কখনো শুনিনি । যাই হোক এখন তুমি ভেবে ঠিক কর ,আমাকে যদি নীচে নামাও , তবে আমি কথা দিচ্ছি , তুমি বেচে যাবে । তোমাকে বন্দি করা হবে না।
সেই কথায় দৈত্য শোনার পরে বার বার তার এক কথাই বলতে লাগল, ‘ননী ননী’?
সেনাপতি অবাক হয়ে দৈত্যেকে দেখতে লাগল।
সেনাপতি অনেক খন চুপ থেকে নিজেকে শান্ত করতে করতে বলল ,” এবার আমাকে নীচে নামিয়ে দাও তো দেখি ।
দৈত্য অন্য সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বল, ‘ননী? দাও’? ‘’
বলতে বলতে দৈত্য সেনাপতিকে নীচে নামিয়ে না দিয়ে এক লাফ দিল। এক লাফে সে বহুদুরের পথ পারি দিল । সেনাপতিকে হাতে নিয়ে এক লাফে অনেক দূরে চলে এল দৈত্য ।
অন্য সেনারা সব অজ্ঞদের মতন হা করে তাকিয়ে থাকল ।
সেনাপতি বোকাদের মতন চেঁচিয়ে বলল,” এটা কি হল ! আরে ,আরে এটা কি হল ”!
সেনাপতি মন খারাপ করে বারবার বলতেই লাগল ,” কি আশ্চর্য ! কি আশ্চর্য ”!
দৈত্য তাকে নিয়ে এল সমুদ্রের তীরে । তীরের কাছে উঁচু একটা জায়গা । দৈত্য দ্রুত হাত দিয়ে বালি সরিয়ে তার এক হাত সমান গর্ত তৈরি করল । গর্তে সেনাপতিকে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল ” ননী? দাও?
দৈত্যের এক হাত সেনাপতি জন্য তার উচ্চতার তিনগুন প্রায় । সে গর্ত এর অনেক নীচু থেকে চেঁচিয়ে বলল ” তুমি আমাকে আটকে রাখতে পারবে না । আর আমরা তোমাকে বন্দি করে নিয়ে যাব আমাদের দেশে ,সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত থেক ”।
দৈত্য আবার গাঢ় গলায় বল, ননী? দাও?
দৈত্য তাকে গর্তে রেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল । আর অনেক খন পরে ফিরে এল কয়েকজন সৈন্য কে দুই হাতে মুঠো করে । তারপর আগেরটার মতন অনেক গুলো গর্ত করে কয়েকজন সৈন্য রাখল সেখানে । তারপর সেনাপতি কে গর্ত থেকে তুলে এনে আবার বল, ননী? দাও?’’
সেনাপতি বিপদটা বুঝলেন। অন্য সৈন্যরাও বুঝলেন, রাজকন্যকে না দিলে রেহাই নেই।
দৈত্য গর্তের পাশে বসে রইল। অনেক খন পরে বাকী সৈন্যরা রাজকন্যাকে নিয়ে ফিরে এল। রাজকন্যা দৈত্যকে দেখেই দৌড়ে ছুটে এল। তখন দৈত্য তাকে কাঁধে নিয়ে ছুটে গেল দূরে। সেনাপতি আর সৈন্যরা হা করে তাকিয়ে রইল।
পরের দিন ভোরে সেনাপতির ঘুম ভাঙ্গতেই দেখল তার পাশে একটা বেশ বড় নৌকা। চোখ ঢলতে ঢলতে লাফিয়ে উঠে অন্য সৈন্যদের ডেকে তুলতে গিয়ে দেখল দূরে দৈত্য হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আর কাঁধে রাজকন্যা।
রাজকন্য নেমে এল। সেনাপতিও দৌড়ে ছুটে এল রাজকন্যার দিকে। রাজকন্যা বলল, অনেক দিন আগে এই নৌকাটা দৈত্যটা খুজে পেয়েছিল সমুদ্রের তীরে। দৈত্যের আচরনে যা বুঝেছি, সে এটা আমাদের উপহার দিতে চাচ্ছে। এটা করে এখন আমরা বাড়ি ফিরে যেতে পারব। দৈত্য তাই চাইছে।
সেনাপতি আবাক গলায় বলল, আমরা সবাই তাহলে বাড়ি ফিরে যেতে পারব? এটা অবিশ্বাস। এই দৈত্য তো দেখি ভীষণ ভালো।
সেই দিন আর যাওয়া হল না। দৈত্য মাছ ধরে আনল, মাছের ফ্রাই করল আর সবাই মিল মজা করে খেয়ে পরের দিন সকালে নৌকায় উঠে বসল।
সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাজকন্যা নৌকায় উঠে বসল। সেনাপতি আর সৈন্যরাও। দৈত্য ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে। খুব জোরে জোরে সে বলে উঠোল, ‘ননী ননী, জন, জন।‘ নৌকা ছেড়ে দিল। রাজকন্যা চিৎকার করে বলল,আমার বাবা রাজা। তিনি জনকে খুজে বের করবে। আমি জনকে নিয়ে ফিরে আসব। কথা দিলাম। তোমাকে আমি ভুলে যাব না‘
নৌকা ঢেউ এর ধাক্কায় দূরে সরে যাচ্ছে। দৈত্য এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। তার চোখে জল। বৃষ্টি পরছে। দৈত্যের চোখের জলের সাথে বৃষ্টির পানি মিশে গেছে, সেই জল গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে সমুদ্রের জলে। দৈত্য আবার চিৎকার করে বলল, ‘ননী ননী । জন জন।‘’