মোঃ নোমান সরকার
নিতুকে বললাম, ‘চুলা জ্বালানো যাবে?’
নিতু বলল, ‘না। এখন না।’
আমি বললাম, ‘পানি গরম করতে হবে। আর তেজপাতা কোথায় রেখেছ, বলত?
‘ নিতু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘পানি গরম করতে হবে মানে? এত ঠান্ডা তো পরেনি। নরমাল পানিতেই গোসল করো। আর তেজপাতা দিয়ে কি হবে?’
‘তেজপাতা পানিতে ডুবিয়ে সেই পানি গরম করে গোসল করব?’ আমি কথাটা বলতে বলতে মুগ্ধ চোখে নিতুকে দেখলাম। সে নীল রং এর একটা শাড়ি পরেছে। নিতু আজকাল সহজে শাড়ি পরে না। ওকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আমি চোখ সরালাম না।
নিতু অবাক হয়ে বলল, ‘তোমার মাথা টাথা ঠিক আছে তো।’
আমি হাসলাম, ‘গায়ে ঘামের বাজে গন্ধ, সারাদিন আজ রোদেই কেটেছে। আর তেজপাতার পানিতে মরা চামড়া উঠে যায় সহজে। ত্বক নরম হয়। সতেজ লাগে। নেটে সার্চ দিয়ে দেখতে পার। কেবল রান্নায় না শতশত বছর ধরেই গসলের পানিতে এর ব্যবহার হচ্ছে।’
নিতু রেগে গিয়ে বলল, ‘এত সাজগোছ! বিষয় কি! আরেকটা বিয়ে করার মতলব হয়েছে। তাই না? বিয়ের বিষ নামানোর মন্ত্র আমার কাছে আছে।’
আমি কিছুক্ষন হাসলাম, ‘তেজপাতা কোথায় রেখেছ?’
নিতু তেড়ে এলো, ‘একটু আগে আমি রান্না ঘর পরিস্কার করেছি। তুমি আমার রান্না ঘর নোংরা করবে না,প্লিজ। আমার সবকিছু জায়গা মত রাখা। সংসার শুরু করার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন একটা জিনিশ এদিক সেদিক হয়নি। আর তুমি রান্না ঘরে ঢুকা মানেই সব এলোমেলো। আমি কিছুতেই দিব না। তুমি সরো।’
আমি বুঝে গেছি আজ আর হবে না তেজপাতা পাওয়া। আরেকটা কাজ করা যায়। কিছুক্ষন অপেক্ষা করা যায়। নিতু রাতে সব কাজ সেরে কম্পিউটারে অন লাইনে খবরের কাগজ পড়ে। খরচ বাঁচাতে দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করেছে নিতু গত মাস থেকে। আমি বাসা থেকে সকালে বের হই, তাই এই নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। দৈনিক পত্রিকা অফিসেই পড়া হয়। কিন্তু নিতু তো পড়ে। মনটা এই নিয়ে খারাপ ছিল। যদিও এ নিয়ে কথা হয়নি। বলতে ইচ্ছেও করছিল না। কাগজে পাতা আর কম্পিউটারের পড়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। সকালের খবরের কাগজের ঘ্রাণ একেবারেই তো আলাদা।
আমি ঠিক করলাম নিতু কম্পিউটারে কাছে বসলেই সেই ফাঁকে রান্না ঘর হানা দেওয়া যাবে। আমি রান্না ঘর থেকে শোবার ঘরে ঢুকতেই নিতুও ঢুকল।
আমি নীচু গলায় বললাম, দেরি করে ফেললাম। মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। ধ্যাত!
নিতু বলল, ‘বাবা! বাবা! করতে করতে ঘুমালো।’
আমি বললাম, আহ! মেয়েটা আমার ঘুমিয়ে গেছে। হুম। তোমার সাথে ছাড়া গল্প করার কেউ নেই। এসো গল্প করি। গল্পের শুরুতে তোমাকে ছুঁয়ে দেই।’
না। এই ময়লা হাতে তুমি আমাকে ছুবে না। যাও, আগে গোসল সেরে নাও।’
আমি বললাম, ‘হুম। আচ্ছা ঠান্ডা পরেছে না খুব?’
নিতু সাদামাটা গলায় বলল,’স্যারের এখন চা লাগবে। তাই না? ওসব হবে না। এখন থেকে ২কাপ চা। নাস্তার পরে আর সন্ধ্যার পর তুমি এলে। আগামী বছর থেকে ইলা যাচ্ছে স্কুলে। বাজে অভ্যাস সব ছাড়তে হবে। একটা নিয়মের ভিতর আসতেই হবে।’
আমি খানিক ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘সব নিয়ম কি আজ থেকে পালন করতে হবে?’
নিতু বলল, ‘গসল সেরে আসো। তারপর নিয়মগুলো নিয়ে আলোচনা করি। আর আজ থেকে শুরু করলে কেমন হয়? চা দিয়ে শুরুটা করা যাক।’
আমি বিরক্ত গলায় বললাম,’খুবই বাজে চিন্তা ভাবনা তোমার। আচ্ছা চায়ের দরকার নেই। একটু পানি গরম করি, কফি খাই।’
নিতু অবাক গলায় বলল,’কফি ফুরিয়েছে দেড় মাস আগে।’
আমিও অবাক হলাম,’বলনি তো!”
নিতু বলল,’বাজারের লিস্টে লেখা আছে। আমি বাজারের লিস্ট তোমাকে মেইল করেছি তাও ৩ দিন আগে।’
আমি পকেট থেকে দ্রুত মোবাইল ফোনটা বের করে মেইল চেক করলাম। বাজারের লিস্ট দেখে আঁতকে উঠলাম, ‘আরে চা পাতাও নেই!’
নিতু গলা নামিয়ে বলল,’তুমি চা খেতে চেয়েছ। আমি দেইনি এমনটা কি হয়েছে? আমি বলতে গিয়েও বলিনি। ভাবলাম যখন লিস্ট দেখবে সেটা তো দেখবেই।’
আমার খুব খারাপ লাগল। তার মানে সকালে আমি আজ চলে গেছি তাড়াহুড়া করে নাস্তা না খেয়ে, দেরি হয়েছিল বলে। তাহলে সকালের চা নিতু খেতে পারেনি।
নিতু পরিবেশটা হাল্কা করতে একটু অভিনয় করে বলল, ‘স্যারের আজকাল শরীরের ঘ্রাণ আর মরা চামড়া নিয়ে ভাবা হয়। কিভাবে ঘরের খবর রাখবে? সুখে আছো বাবু।’
আমি ভারী লজ্জা পেলাম। বারেন্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারেন্দার গ্রীল্টাকে খামচে ধরে রাতের আকাশের দিকে তাকালাম। রাতের আকাশটা মেঘে ঢেকে আছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়েই রইলাম। আচ্ছা,আকাশটা কত বড়। আকাশ এত বড় কেন? আর আমাদের মাটির পৃথিবীটা এত ছোট কেন? এই প্রশ্নের ভিতর আমি ডুবে গেলাম।
নিতু এসে পাশে দাঁড়াল। একটা হাত রাখল আমার কাধে। আমি খুব নীচু গলায় বললাম, আকাশটা এত বড়! আর পৃথিবীটা কত ছোট! ছোট পৃথিবী!