গল্প মা
মোঃ নোমান সরকার
অনেক অনেক দিন আগের কথা। আমাদের দেশে এক গ্রামে বাস করত এক বুড়ি মা। তিনি একটুতেই রেগে যেতেন। আর একবার রেগে গেলে রাগ থামতই না। রেগে গেলেই মানুষকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতেন। আর বলতেই থাকতেন। আর কটু কথা রেগে রেগে বলতেন। তিনি তার এক তলা পাকা বাড়িতে একাই থাকতেন। বাড়িটা বাজারের কাছাকাছি হওয়াতে অনেক মানুষ এই পথে যাতাযাত ছিল। বাড়ির সামনে মস্ত বড় বারেন্দা, বুড়ি মা সকালের রোদ পোহাতে বারেন্দায় এসে বসতেন বলে সবাই তাকে চিনত।
একদিন বুড়ি মায়ের অসুখ হল। কিন্তু কেউ তাকে দেখতে এলো না। একদিন যায়, দুই দিন যায়। কেউ যখন দেখতে এলো না তখন বুড়ি মা বুঝলেন তার রাগের জন্য আর কটু কথা বলার জন্য কেউ তাকে পছন্দ করে না। তাই কেউ তাকে দেখতে আসেনি, খবর নেয়নি।
অসুখের দ্বিতীয় দিন থেকে তিনি অস্থির হয়ে গেলেন। আর অধীর হয়ে গেলেন কারো সঙ্গ পাওয়ার জন্য। তিনি চেষ্টা করলেন খুব অল্প সময়ের জন্য বাইরে যেতে। কিন্তু নিজের শরীরটাকে এত ভারী মনে হচ্ছিল যে বেশীক্ষণ বাইরে থাকা হলো না। তিনি কুঁজো হয়ে বারেন্দায় হাঁটলেন, যাতে মানুষ বুঝে তিনি অসুস্থ। তাকে এভাবে হাঁটতে দেখেও কেউ এগিয়ে এলো না। তিনি ঘরে ফিরে আয়নার কাছে এসে বসলেন। অনেকক্ষণ বসে থেকে তিনি আয়ানার মানুষটিকে বললেন, ‘’ভালোকে সবাই ভালোবাসে। মন্দকে না।‘’
তার মনে হতে লাগল কত কথা। তিনি কারো সাথে ভালো আচরণ করেননি। কষ্ট দিয়েছেন, কষ্ট দিয়ে কথা বলেছেন কেবল। তাই তার বিপদে কেউ আসেনি। কেউ খবর নেয়নি। তিনি নিজেকে বললেন, আহা! আমি কি এতটা খারাপ, এতটা খারাপ কাজ করে ফেলেছি যে মানুষ আমাকে এড়িয়ে চলে! তিনি মনে মনে ঠিক করলেন,আর কখনো তিনি রেগে যাবে না, কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলবেন না। আর কটু কথা বলবেন না। সব বিষয়ে তিনি ধরয্য ধরবেন। নিজের সাথে তিনি অনেক কথা বললেন। তিনি নিজেকে এ নিয়েও অনেক বুঝালেন।
তৃতীয় দিনের দিন সেই গ্রামের একজন মানুষ তাকে দেখতে এলো। বুড়ি মা তাকে চিনেন। তিনি একজন জ্ঞানী লোক, নাম লোকমান। তিনি বুড়িমাকে দেখতে আসছে্ন। বুড়ি মায়ের চোখে পানি চলে এলো।
বুড়িমা দেখে লোকমান সাহেব খুব কষ্ট পেলেন। তিনি খাবার সাথেই নিয়ে এসেছিলেন। সেই খাবার বের করে তিনি নিজেই তা খাইয়ে দিলেন। তখন বুড়ি মা নিজ থেকে নরম গলায় বলতে গিয়ে কিছু বলতে পারলেন না। চুপচাপ সময় কেটে যেতে লাগল। তারপর অতি ধীরে ধীরে বুড়ি মা বললেন,’আমি আর কাউকে কটু কথা বলব না।‘
জ্ঞানী লোক লোকমান সাহেব তা নিয়ে কিছু বললেন না। খাবারের শেষে তিনি বললেন, আপনি তো একা থাকেন। সময় কাটানোটা কঠিন। আচ্ছা, আপনি কি বই পড়তে পছন্দ করেন?’
বুড়ি মা না সূচক মাথা ঝাঁকাল। লোকমান সাহেব বললেন,’সুস্থ হলে আপনি বই পড়বেন। আপনি যদি বই পড়েন তখন সবাই আপনাকে অনেক ভালবাসবে। আমি আপনার জন্য খাবার আর বই নিয়ে এসেছিলাম।‘
বুড়ি মা অবাক হলেন। যে বই পড়ে তাকে মানুষ ভালবাসে! এটা অদ্ভূত কথা তো! এমন কথা কখনো তিনি শুনেননি। বুড়ি মা তাই মনের কথাটি বলে ফেললেন অবাক বিস্ময়ে,’ এমন আদ্ভুত কথা কখনো তো শুনিনি। যে বই পড়ে তাকে মানুষ ভালবাসে!’ ‘ জ্ঞানী মানুষ বুড়িমাকে সব বুঝিয়ে বললেন।
জ্ঞানী মানুষ প্রতিদিন উনাকে সকাল বিকাল দেখে যায়। কি কি লাগবে, তা এনে দিয়ে যায়। দুই দিন পরেই বুড়ি মা সুস্থ হলেন। সুস্থ হতেই তিনি ঘরের বারেন্দায় একটা আরাম কেদরায় হেলান দিয়ে বসে বই পড়তে লাগলেন সকাল বিকাল।
বলতে গেলে সেই দিন থেকে সারাদিন বই নিয়েই থাকেন তিনি। বুড়ি মা বাড়ির সামনের পথ দিয়ে আসা যাওয়ার পথের মানুষেরা সবাই তা কাছে বা দূর থেকে দেখতে লাগল। এভাবে প্রতিদিন বারান্দায় বসে বুড়ি মাকে বই পড়তে দেখে একজন একজন করে সবাই ভয়ে ভয়ে এলেন। কিন্তু কেউ কথা বললেন না। পাছে বুড়ি মায়ের কটু কথা যদি শুনতে হয়। তাই সেই পথের কাছ দিয়ে যেই যায়, সে বুড়ি মায়ের বারান্দার কাছে এসে কিছুক্ষন দাঁড়ায়। তারপর এমন চুপিচুপি এসেছিল,তেমন করে চলে যায়।
এভাবে অনেক দিন কেটে যাবার পর সবাই খেয়াল করল বুড়ি মা কাউকে কিছু বলেন না, কটু কথা তো দূরে থাক বিরক্ত হয়ে তাকায়ও না। সবাই এতে সাহস পেল। একে একে একজন দুইজন করে সবাই জানতে চাইলেন,‘বুড়িমা এই কয়দিন কোথায় ছিলেন? কেমন আছেন? কি করেন? কি পড়েন?’ প্রতিবারই বুড়ি মা সবাইকে অবাক করে দিয়ে হেসে উঠে অতি নরম গলায় সবাইকে জানিয়ে দিলেন, তিনি এখন বই পড়েন। বই পড়েন বলে ঠিক মতন কারো সাথে কথা বলতে পারছেন না। আর সবাইকে তিনি বই পড়তে বললেন। বার বার সবাইকে বলেন,’বই হচ্ছে বন্ধু।‘
সবাই বেশ অবাক হয়ে দেখল বুড়িমা এত টুকু রাগ করে কথা বলছে না। ধীরে ধীরে সবাই সেই কথা জেনে গেল। আর তাকে দেখতে মানুষ আসতে লাগল। আসতেই লাগল। কেউ ফল আনে তো, কেউ ফুল। শিশুরাও এল। কিশোর আর কিশোরীরাও।
শিশুদের দেখে বুড়িমা বলল, তোমরা আমার কাছে গল্প শুনবে? শিশুরা সবাই এক যোগে রাজী হয়ে গল্প শুনতে বসে পড়তে লাগল। বড়রা তো অবাক। আরে কি করে বুড়িমা বদলে গেল! বই এর এত ক্ষমতা! যে বুড়ি মাকে সবাই এড়িয়ে চলত, আজ তাকে কেবল শ্রদ্ধাই করতে ইচ্ছে করে। কত সুন্দর করেই না তিনি কথা বলেন! কত মুল্যবান কথা বলেন! কতই না গুরুত্বপূর্ণ! বই এর তাহলে এত ক্ষমতা! পড়তে হবে আমাদেরও, সবাই প্রতিজ্ঞা করে যে যার বাড়ি ফিরে।
বই পড়ে কি তাহলে বদলে যাওয়া যায়! কাছে বা বহু দূর থেকে মানুষ বুড়িমাকে বারেন্দায় বই পড়তে দেখেন আর ভাবেন। আর অবাক বিস্ময়ে মানুষগুলো দেখে তাদের অতি চেনা অসম্ভব রাগী বুড়িমা বই এর ছোঁয়ায় বদলে গেছে। তিনি গল্প বলছেন আর শিশুরা মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনছে! তিনি হাসছেন, শিশুরাও।
আস্তে আস্তে বুড়ি মার নাম বদলে গেল। কেউ আর বুড়িমা বলে ডাকে না। এখন সবাই ডাকে গল্প মা বলে।
2 comments
ভাই কি ভাল লেখা আপনার
তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ!